করোনার পর হরতাল-অবরোধে শিক্ষায় ফের বিপর্যয়ের শঙ্কা

গেল কয়েকদিনের হরতাল-অবরোধে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে
গেল কয়েকদিনের হরতাল-অবরোধে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে  © সংগৃহীত

দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী প্রায় তিন কোটি। দেশব্যাপী বিএনপির ডাকা অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি খুবই নগন্য। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী উপস্থিতি না থাকায় ক্লাসের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। আবার বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র ঠিক তার উল্টো। অন্যান্য দিনের মতই স্বাভাবিক নিয়মে চলছে তাদের শিক্ষাকার্যক্রম।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রমেও দেখা দিয়েছে এক ধরনের স্থবিরতা। হরতাল-অবরোধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগে নিয়মিত পরীক্ষা স্থগিতের ঘটনা ঘটে। পরের দিন অবশ্য এসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে না গেলেও এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। আতঙ্ক কাজ করছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে। হরতাল-অবরোধে গেল কয়েকদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সময় দুই বছরেরও বেশি সময়ের এক বড় ধাক্কা এসেছিল শিক্ষাখাতে। সে ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা বছরের সময় কমিয়ে সে ক্ষতি কাটিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে হরতাল-অবরোধে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে না পারলে করোনার পর ফের বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে এ খাতে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা এইরকমভাবে অব্যাহত থাকলে প্রাথমিকের বার্ষিক পরীক্ষা, নতুন শিক্ষাক্রমের বার্ষিক মূল্যায়ন ও স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা যথাসময়ে আয়োজন কঠিন হবে।

গত ২৮ অক্টোবর (শনিবার) রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক দফা দাবি আদায়ে মহাসমাবেশ করে বিএনপি। মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংস ঘটনা ঘটে। পরদিন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে দলটি।

এরপর এক দিন বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। মাঝখানে শুক্র ও শনিবার বিরতি দিয়ে রবিবার থেকে আবার ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ দেওয়া হয়। ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে এক দিনের বিরতি দিয়ে আবার ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ কর্মসূচি শেষ হবে আগামীকাল শুক্রবার সকাল ৬টায়।

এ মুহূর্তে হরতাল দেশের অর্থনীতিতে কতখানি ক্ষতি কর...

দলটির নেতারা সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি বিরতি দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন তারা।

এদিকে, হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি এভাবে দীর্ঘ হতে থাকলে শিক্ষার্থীরা কীভাবে তাদের আসন্ন বার্ষিক পরীক্ষা ও মূল্যায়ন শেষ করবে এই চিন্তায় রয়েছে শিক্ষক ও অভিভাবকেরা। এ ধরনের কর্মসূচি সব মূল্যায়ন ও বার্ষিক পরীক্ষার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এর আগে, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রভাবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দেশের শিক্ষাখাতে নেমে আসে বড় বিপর্যয়। দেশে এই ভাইরাস প্রথম চিহ্নিত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। ওইদিন যে তিনজনের করোনাভাইরাস ধরা পড়ে, তাদের দুইজনই ছিলেন ইতালি-ফেরত। আরেকজন তাদের আত্মীয়।

পরে ২০২০ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশ লাগোয়া ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয় সেখানকার কর্তৃপক্ষ। ততদিনে বিশ্বের শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল এই ভাইরাস। সতর্কতার অংশ হিসাবে এ রকম অনেক দেশেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর কয়েকদিন পর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার।

এরপর টানা প্রায় ১৮ মাস বন্ধের পর ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়। করোনার এ ধাক্কায় ১৮ মাসে দেশের ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শুধু পড়াশোনায় নয়, শারীরিক ও মানসিকভাবেও। ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন (ক্যাম্পে) আয়োজিত মেয়েদের ক্ষমতায়নে শিক্ষা ও করণীয় শীর্ষক মতবিনিময় সভায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এ চিত্র উঠে আসে।

হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যা হয়েছে, জনমনে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যারা এই কর্মসূচিগুলো দিচ্ছেন তারা কি লাভবান হতে পারবেন? -ডা. দীপু মনি, শিক্ষামন্ত্রী

জানা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরুর কথা ছিল গত ৫ নভেম্বর। কিন্তু পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে এই মূল্যায়ন কার্যক্রম। নতুন সূচি অনুযায়ী আজ ৯ নভেম্বর থেকে এ দুই শ্রেণির সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা গেছে।

ঢাবির বিভিন্ন ফটকে ছাত্রদলের তালা

বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল-অবরোধ সমর্থনে সরব রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সড়কে সড়কে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে তারা নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। অন্যদিকে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভবনে ভবনে তালা দেওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ফটক ও কক্ষে তালা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে সংগঠনটি।

চলমান হরতাল অবরোধের রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যা হয়েছে, জনমনে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যারা এই কর্মসূচিগুলো দিচ্ছেন তারা কি লাভবান হতে পারবেন? অনেক শিক্ষার্থী তো এখন ভোটার। ভোটার শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তায় ফেলার এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে না।

অনেক অভিভাকও তাদের সন্তানদের অবরোধের মধ্যে বিদ্যালয়ে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে যাদের বাসা বিদ্যালয় থেকে বেশকিছুটা দূরে। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হরতাল অবরোধে সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় তাদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাদের সন্তানদের নিরাপত্তার বিষয়টি তাদেরকেই দেখতে হবে।

তারা মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এইরকমভাবে অব্যাহত থাকলে প্রাথমিকের বার্ষিক পরীক্ষা, নতুন শিক্ষাক্রমের বার্ষিক মূল্যায়ন ও স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা যথাসময়ে আয়োজন কঠিন হবে।

অবরোধকালে পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি খুবই নগণ্য । কেউ আবার বিদ্যালয়ে এসে ফিরে গেছেন। হাতেগোনা অল্প কয়েকটি বিদ্যালয় ছাড়া বাকি বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস হলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম।

হরতাল-অবরোধে শিক্ষাব্যবস্থায় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করে শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, হরতাল-অবরোধে শিক্ষার ক্ষতিই হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সামনে আরো ক্ষতি বাড়বে বলে শষ্কা রয়েছে। তবে যারা যারা এটার স্টেকহোল্ডার, যারা প্রোগ্রাম দিচ্ছে, যারা প্রোগ্রামটা দিতে বাধ্য করছে, সব পক্ষেরই উচিত এগুলা আলোচনা করে কিছু একটা করার। কারণ শিক্ষার এই ক্ষতিগুলো পুরোপুরি পুষিয়ে নেওয়া যায় না। হয়তো চেষ্টা করলে পুষিয়ে নেওয়া যাবে, তবে সেটি অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

মাউশির সূত্রগুলো বলছে, ঘোষিত সময়েই বার্ষিক পরীক্ষা ও সামষ্টিক মূল্যায়ন নেয়ার সিদ্ধান্ত আছে। তবে এরপর পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী হয়তো নতুন পদক্ষেপ নেয়া হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নভেম্বরে স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করতে না পারলে ডিসেম্বরে নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হবে না। আগামী বছর আরো তিনটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর যে পরিকল্পনা রয়েছে সেটাও যথাসময়ে শুরু করা কঠিন হবে।

হরতাল-অবরোধ বন্ধে আইন করার দাবি

হরতাল-অবরোধে  বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস কার্যক্রম চললেও পেছানো হয়েছে চূড়ান্ত পরীক্ষা। আর অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ করা হয়েছে ক্লাসও। সবমিলিয়ে এলোমেলো হতে শুরু করেছে শিক্ষা সূচি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগ পরিবহণ নির্ভর হওয়ার কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলো। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নিয়মিত ক্লাস কার্যক্রম চলার ঘোষণা থাকলেও ভয়-শঙ্কা তাড়া করছে শিক্ষার্থীদের।

করোনাভাইরাসের সময় দুই বছরেরও বেশি সময়ের এক বড় ধাক্কা এসেছিল শিক্ষাখাতে। সে ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা বছরের সময় কমিয়ে সে ক্ষতি কাটিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে।

স্কুল-কলেজগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, স্কুলগুলোতে ৯ নভেম্বর থেকে বার্ষিক মূল্যায়ন শুরু হবে। তাই এখনই অন্য কোনো বিষয় ভাবার সময় আসেনি। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করতে হবে।

আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মুহাম্মদ ফাজলী ইলাহী জানান, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আমাদের অধিকাংশ ক্লাস অনলাইনে হচ্ছে। তবে কিছু কিছু ক্লাস অফলাইনেও আয়োজন করা হচ্ছে। সব ক্লাস অনলাইনে আয়োজন করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে ব্যবহারিক ক্লাসগুলো।

নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার ড. আহমেদ তাজমীন বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি। কিছু পরীক্ষাও অনলাইনে আয়োজন করা হচ্ছে। অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি না থাকলে অফলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence