ঢাকা-চায়না ডে ২০২৫

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বন্ধুত্ব, সংস্কৃতি ও সহযোগিতার উদযাপন

দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক, শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক, শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন  © সংগৃহীত

বাংলাদেশে অবস্থিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের দূতাবাসের সহযোগীতায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ) বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্বের একটি প্রাণবন্ত উদযাপন হিসেবে ঢাকা-চায়না ডে ২০২৫-এর আয়োজন করেছে। অডি ৮০১ এবং প্রধান অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক, শিক্ষার্থী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা অংশগ্রহণ করেছেন। পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল আলোচনা, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার মিলনক্ষেত্র।

উদ্বোধনী পর্বটি ছিল দিনের প্রধান আকর্ষণ। এটি শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী সিংহ নৃত্য (Lion Dance) দিয়ে, যা সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের প্রতীক। এনএসইউতে অনুষ্ঠিত ঢাকা চায়না ডে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দৃঢ় বন্ধুত্ব এবং বহুমুখী সহযোগিতার গুরুত্বকে সামনে এনেছে। 

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী বলেন, ‘এনএসইউতে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ভাষা শিক্ষা, ছাত্র বিনিময় এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।’

হাই কমিশনার ইয়াও ওয়েন, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশ, বলেছেন, ‘বাংলাদেশ–চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।’ তিনি যুবসমাজের সম্পৃক্ততা ও জনগণ-মুখী বিনিময়ের গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন। 

বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘বাণিজ্য, মৎস্য ও প্রযুক্তিতে সহযোগিতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে এবং উভয় দেশের জন্য লাভজনক হবে। যুব ও উদ্যোক্তাদের এই অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করতে উৎসাহিত করেছেন।

এনএসইউ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা আজীবন সদস্য ও বোর্ড অব ট্রাস্টি সদস্য জনাব বেনজীর আহমেদ, চীনের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক সহায়তাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এবং যোগ করেছেন যে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট সম্প্রসারণ করা হবে, যা একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতাকে আরও বিস্তৃত করবে।

দিনটিতে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক দুটি প্রযুক্তিগত সেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সেশনটি সঞ্চালনা করেন এনএসইউ’র রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এস. এম. রেজওয়ান উল আলম। তিনি ভ্রান্ত ধারণা দূরীকরণে গণমাধ্যমে সাক্ষরতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মিডিয়া, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা প্রোগ্রামের প্রভাষক মৃত্তিকা আনান রহমান, তাঁর গবেষণা উপস্থাপন করেন। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের গণমাধ্যম চীনকে মূলত উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে উপস্থাপন করে; এর পাশাপাশি কূটনীতি, শিক্ষা, প্রযুক্তি, বন্ধুত্ব ও সংস্কৃতির বিষয়গুলোও গুরুত্ব পায় এবং সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক কাভারেজ দেখা যায়।

সিএমজির ব্যুরো প্রধান মি. ওয়াং জিয়ানবিং পরিবর্তিত গণমাধ্যম ভোগের ধারা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে তরুণ প্রজন্ম ক্রমে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সরে যাচ্ছে এবং সিএমজি বাংলা ভাষার কনটেন্টের মাধ্যমে তাদের যুক্ত রাখতে কাজ করছে।

চীনা দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কাউন্সেলর মি. লি শাওপেং বর্ণনার শক্তি তুলে ধরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে চীনের ইতিবাচক উপস্থাপনার জন্য ধন্যবাদ জানান এবং গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক বোঝাপড়া আরও গভীর করার আহ্বান জানান।

দ্বিতীয় সেশনটি সঞ্চালনা করেন এনএসইউ এসআইপিজির পরিচালক অধ্যাপক এসকে তৌফিক এম. হক। তিনি বাংলাদেশে চীনা ভাষার ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব তুলে ধরেন, বিশেষ করে বাণিজ্য সম্পর্কের কারণে। অধ্যাপক বুলবুল সিদ্দিকী ও মিস মা শিয়াওইয়ান (কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট, এনএসইউ) উল্লেখ করেন যে চীনা ভাষা শিক্ষা মূলত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ, যেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব ও স্কুল পর্যায়ে সীমিত অন্তর্ভুক্তির মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। 

ইলহাম আদনান আলম (বিআইটি) স্কুল পাঠ্যক্রমে চীনা ভাষা যুক্ত করার জটিলতার কথা বলেন, তবে কাঠামোবদ্ধ প্রোগ্রাম, হালনাগাদ উপকরণ ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ওপর জোর দেন। অধ্যাপক মহিউদ্দিন তাহের (শান্ত-মারিয়াম কনফুসিয়াস ক্লাসরুম) ভাষাটিকে জনপ্রিয় করতে সরকারি সম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। অন্যদিকে, ড. কে এম কাবিরুল ইসলাম বহুভাষিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্তরে শেখানো এবং নীতিগত সংস্কারের গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করেন। 

সেশনটির সমাপনীতে, মি. লি শাওপেং, বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কাউন্সেলর, বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং উল্লেখ করেন যে চীনা ভাষা শিক্ষা উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান ও গভীর সাংস্কৃতিক সম্পর্কের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে।

ঢাকা চায়না ডের অংশ হিসেবে অনুষ্ঠিত চীন-বাংলাদেশ ইয়ুথ ফোরামে দুই দেশের শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার নানা দিক তুলে ধরেন। সেশনটি শুরু হয় চীনা দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলর লি শাওপেং-এর বক্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বাংলাদেশ–চীন সম্পর্ক জোরদারে যুবসমাজের সম্পৃক্ততা ও ভবিষ্যৎ সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেন।

ড. মোনিরা সুলতানা চীনকে উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হিসেবে ক্রমবর্ধমান আকর্ষণের কথা উল্লেখ করেন, অন্যদিকে ড. মো. শহিনুর রহমান সাংস্কৃতিক অভিযোজন ও আন্তরিক বন্ধুত্ব গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ড. মুহাম্মদ মফিজুর রহমান চীনের দ্রুত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও টেকসই অংশীদারিত্বের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এবং খান মেহেদী হাসান অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করেন। 

চীনের পক্ষ থেকে ফেং জিয়ে বাংলাদেশে তার মাঠকর্মের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, ওয়াং জিনশুয়ান স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে অভিযোজনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং মিস ঝু মেইচেং ভাষাকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের সেতু হিসেবে উল্লেখ করেন। এছাড়া ড. মো. শাহাবুল হক এবং ড. মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম অবকাঠামো, পরিবহন ও একাডেমিক এক্সচেঞ্জে চীনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন।

উৎসবের সমাপ্তি ঘটে ঢাকা-চায়না ডে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে। ২৩ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত এই তিন দিনের চলচ্চিত্র উৎসবে The Truth 1, Ne Jha 1, উৎসব এবং The Truth 2 প্রদর্শিত হয়, যা দর্শকদের চীনা এবং বাংলাদেশি সংস্কৃতির এক অনন্য অভিজ্ঞতা প্রদান করে। ঢাকা-চায়না ডে ২০২৫ সফলভাবে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বহুমুখী দিকগুলো তুলে ধরেছে, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং তরুণদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করেছে এবং দুই দেশের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় করেছে।


সর্বশেষ সংবাদ