গণভ্যুত্থানের বর্ষপূতিতে এনএসইউতে সংলাপ ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী শুরু
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৫, ০৭:২৬ PM , আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫৪ AM
ছাত্র-জনতার গণভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) এবং জার্মানির আর্নল্ড বার্গস্ট্রাসার ইনস্টিটিউট (এবিআই) যৌথভাবে আয়োজন করেছে এক বিশেষ সংলাপ ও তিন দিনব্যাপী আলোকচিত্র প্রদর্শনী। আজ বুধবার (৬ আগস্ট) রাজধানীর বসুন্ধরায় এনএসইউ ক্যাম্পাসে এ আয়োজন শুরু হয়। এনএসইউ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ-এর সদস্য এবং ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা আজীবন সদস্য এ. কে. কাশেম আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।
“এক বছর পর: তারুণ্যের ভূমিকা ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ ফিরে দেখা” শীর্ষক সংলাপে বক্তারা ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বলেন, গণতন্ত্র কেবল একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো নয়, এটি একটি চেতনা—যা তরুণদের আত্মত্যাগ ও সক্রিয় অংশগ্রহণে বেঁচে থাকে। বক্তারা আরও বলেন, এনএসইউ-এর শিক্ষার্থীরা সেই সময় বুক চিতিয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। জীবনবাজি রেখে তারা যেভাবে আন্দোলনে অংশ নেয়, তা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রধান অতিথি আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ২০২৪ সালের আন্দোলন একটি নতুন, রূপান্তরমূলক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, “মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও প্রতিবাদ করেছে, কারণ আমাদের তরুণ প্রজন্ম শাসকের ভয়কে অতিক্রম করেছে। বিপ্লব শেষ নয়—এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই বিপ্লবকে ধারণ করতে হবে এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”
ড. নজরুল আরও বলেন, “যে দেশগুলো মানবাধিকারের কথা বলে, তারাই অস্ত্র বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্য দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এই দ্বৈত মানদণ্ড মোকাবিলা করতে হলে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা ও শিক্ষার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।”
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন বলেন, “ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ডান-বাম, ইসলামি-ধর্মনিরপেক্ষ বা শ্রেণিগত বিভাজন কোনো প্রভাব ফেলেনি। সকলেই এক পতাকার নিচে দাঁড়িয়েছিল কেবল বাংলাদেশের জন্য। এখন সময় এসেছে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের, যা সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক হবে।”
প্যানেল আলোচনায় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ববি হাজ্জাজ ছাত্রদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বলেন, “এই আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক ছিল না; এটি ছিল আত্ম-উপলব্ধির এক যাত্রা। প্রত্যেকের উচিত এই মুহূর্তটিকে উদযাপন ও সংরক্ষণ করা।” তিনি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং তারিখ ঘোষণার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
অ্যাডভোকেট শিশির মনির রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ—বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং আইনসভার মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাবের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, “যদি এই তিনটি শাখা সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে পড়বে। আমাদের লক্ষ্য হলো আগামী নির্বাচন ও শাসনব্যবস্থা যেন সংবিধানের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।”
আট বছর গুম থাকার পর ফিরে আসা ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম বলেন, “আমার মনে হয় যেন আমাকে কবরে পুঁতে রাখা হয়েছিল। আমরা আজ যে কথা বলতে পারছি, তার পেছনে হাজার হাজার তরুণের আত্মত্যাগ রয়েছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না—মানুষকে দলীয় পরিচয়ে নয়, মানুষ হিসেবেই দেখতে শিখতে হবে।”
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ মন্তব্য করেন, “আজকের বাংলাদেশ যেন একটি সিনেমার মঞ্চ—এক দল চিৎকার করছে, এক দল নীরব, আর একদল হাসতে হাসতে মৃত্যুকে বরণ করছে। এই তৃতীয় পক্ষই স্বাধীনতার প্রকৃত প্রতীক। আমাদের সৃষ্টিকর্তা এখন দোলাচলে—এই আন্দোলন সফল হবে নাকি ব্যর্থ হবে, এটাই আজকের প্রশ্ন।”
শহীদ তানভীনের মা মিসেস বিলকিস জামান, গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত থেকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেন, “আমার ছেলে আন্দোলনে গিয়েছিল এবং লাশ হয়ে ফিরে এসেছে। আমি চাই না আর কোনো মায়ের বুক খালি হোক। ওর মৃত্যু যেন বৃথা না যায়, অন্যায়ের বিচার যেন হয়।” তার কথা উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে গভীর আবেগ ও শোকের ছাপ ফেলে।
বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার এবং সমাজকর্মী শহিদুল আলম বলেন, “১৯৭১ এবং ২০২৪—উভয় সময়েই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রতিরোধের চালিকাশক্তি ছিল। বেশিরভাগ শহীদই ছিলেন শ্রমজীবী মানুষ। পরিবর্তন আনতে হলে তাদের কণ্ঠকে কেন্দ্রে আনতে হবে।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশে নিযুক্ত চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স ড. বার্ন্ড স্পেনিয়ার বলেন, “গত বছর জুলাইয়ে যা ঘটেছে, তা দেখে আমি বুঝেছি যে একটি ছোট দাবিও একটি বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তবে সেই পরিবর্তনের সাফল্য নির্ভর করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মৌলিক রূপান্তরের ওপর।”
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী। তিনি বলেন, “শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না। যদি এক প্রজন্ম আত্মত্যাগ করে, তাহলে পরের প্রজন্ম তার সুফল ভোগ করতে পারে। আমাদের সকলকে মানুষের মর্যাদায় বিশ্বাস রাখতে হবে, যাতে জাতি কখনো মাথা নত না করে।”
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক এবং সিপিএস-এর পরিচালক ড. এম জসিম উদ্দিন তার সূচনা বক্তব্যে বলেন, “এই সংলাপ কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি একটি ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহন করছে। গণতন্ত্র কোনো রাজনৈতিক কাঠামো নয়; এটি আত্মার চেতনা। স্মৃতি এবং শিক্ষা—এই দুটি পথের মাধ্যমেই আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তি নির্মাণ করতে হবে।”
এই সংলাপ ও প্রদর্শনী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে ইতিহাস, ত্যাগ এবং সংস্কার নিয়ে নতুন করে ভাবনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। বক্তারা সর্বসম্মতভাবে একমত হন যে, গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য সাংবিধানিক সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং স্মৃতির সংরক্ষণ অপরিহার্য।