২৮ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অনীহা, ভোগান্তিতে লাখো শিক্ষার্থী

ইউজিসির লোগো এবং উচ্চশিক্ষার প্রতীকী ছবি
ইউজিসির লোগো এবং উচ্চশিক্ষার প্রতীকী ছবি  © সম্পাদিত

উচ্চশিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য সমাবর্তনকে আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সমাবর্তন ছাড়া সরকারি বেসরকারি কেনো বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদের মূল সনদ প্রদান করে না। তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্দিষ্ট একটা সময় পর সমাবর্তন আয়োজনের প্রবণতা দেখা গেলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায় উলটো চিত্র। অন্তত ২৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেখানে সমাবর্তন আয়োজনের তেমন আগ্রহ নেই। যার ফলে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখো শিক্ষার্থী নানা ভোগান্তিতে পড়েছেন।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মিত সমাবর্তনের আয়োজন করলেও তালিকায় নিচের দিকে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমাবর্তন আয়োজনের প্রবণতা দেখা যায় না। এমন পরিস্থিতিতে ভোগান্তিতে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ডিগ্রি নেয়া লাখো শিক্ষার্থী। প্রতিষ্ঠার পর  এখনো কোনো সমাবর্তন আয়োজন করতে পারেনি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা রয়েছে ২৮টি।

‘তাদেরকে হয়ত রাতারাতি বন্ধ করে দেয়া সম্ভব না, তবে আমরা নতুন পরিকল্পনা তৈরি করছি। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সকল কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য তাদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া হবে। তবে নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের আগে আমরা অন্তত হাজার বার ভাবব— প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজ, চেয়ারম্যান, ইউজিসি

ভোগান্তিতে থাকা শিক্ষার্থীরা জানান, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিদাতারা গ্র্যাজুয়েটদের মূল সনদকে গুরুত্ব দেন। আর চাকরি ছাড়াও কোনো শিক্ষার্থী যদি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চান, স্কলারশিপ পাওয়ার পর মূল সনদ জমা দিতে হয় বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মূল সনদে নিতে হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সত্যায়নও। কিন্তু মূল সনদ না পাওয়ায় অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটরা স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে পারছেন না।

উচ্চশিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, সমাবর্তন ছাড়া মূল সার্টিফিকেট দেওয়ার নিয়ম নেই। সমাবর্তন আয়োজনে অনীহা থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের ‘প্রবেশনারি’ সার্টিফিকেট দিয়ে বছরের পর বছর পার করছে। কিন্তু দেশের বাইরে কর্মক্ষেত্র কিংবা উচ্চশিক্ষার জন্য কেউ যেতে চাইলে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

আরো পড়ুন: ‘স্বতন্ত্র পরিচয়ে’ সাত কলেজ নাকি বিশ্ববিদ্যালয় হবে?

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পার করেও কোনো সমাবর্তনের আয়োজন করেনি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা রয়েছে ৪টি। রাজধানীতে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা। এ তালিকায় আরো রয়েছে সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং আনোয়ার খান মডার্ন ইউনিভার্সিটি।

প্রতিষ্ঠার পরে এখন পর্যন্ত কোনো সমাবর্তনের আয়োজন করতে পারেনি রাজধানীর বাইরে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৪টি। এরমধ্যে রয়েছে, বগুড়ার পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মুন্সীগঞ্জের হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, সিলেটের নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, কিশোরগঞ্জের ঈশাখাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি,  শরীয়তপুরের জেড. এইচ. সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, কুমিল্লার ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ফরিদুপরের টাইমস্ ইউনিভার্সিটি, রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, নাটোরের রাজশাহী সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, জামালপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইউনিভার্সিটি, কক্সবাজারের কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

আমাদের কাছে নির্দিষ্ট কোনো ডাটা নেই। তবে যারা নিয়মিত সমাবর্তনের আয়োজন করে না, তাদেরকে আমরা বরাবরই বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস হতে বলি ড. মো. সুলতান মাহমুদ ভূইয়া, পরিচালক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ইউজিসি

তালিকায় আরো রয়েছে, নারায়ণগঞ্জের রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরের জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, বরিশালের গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সৈয়দপুরের বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ- টেকনোলজি, নাটোরের বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লার বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মানিকগঞ্জের এন. পি. আই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, কুষ্টিয়ার রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি এবং বরিশালের ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ।

আরো পড়ুন: ডা. জাফরুল্লাহ’র মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় দখল গণস্বাস্থ্যের মেডিক্যাল কলেজ

এছাড়া ঢাকার বাইরে অবস্থিত অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যারা প্রতিষ্ঠার পরে কোন সমাবর্তনে আয়োজন করেনি। ইউজিসির তালিকা অনুযায়ী ইউজিসি কর্তৃক অনুমোদিত ১১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বর্তমানে ১১১টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে সমাবর্তনের আয়োজন না করা বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সদিচ্ছার অভাবে সমাবর্তনের আয়োজন করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। 

সম্প্রতি বেসরকারি প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে স্থবিরতা দেখা যায়। সমাবর্তন জটে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রাইম এশিয়া অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক এক শিক্ষার্থী কামরুন্নাহার বলেন, ‘আমি উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ও পেয়েছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি সার্টিফিকেট তুলতে। কিন্তু মূল সনদ পাচ্ছি না। সমাবর্তন ছাড়া মূল সার্টিফিকেট ইস্যু করছে না কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশকিছু ঝামেলা চলছে, এসবের সঙ্গে আমার জড়িত হওয়ার ইচ্ছে নেই। কিন্তু মূল সনদ ছাড়া অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।’

যদিও কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত সমাবর্তনের আয়োজন করছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন আয়োজন করেনি এ সংক্রান্ত হালনাগাদ কোনো তালিকা ইউজিসির কাছেও নেই। তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর এখনো কোনো সমাবর্তনের আয়োজন করতে পারেনি এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অন্তত ৩০টিরও বেশি রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কোনটির বয়স ২০ বছরেরও বেশি হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত এক থেকে দুবার সমাবর্তন আয়োজন করেছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

আরো পড়ুন: অভিভাবক ছাড়াই চলছে ৩২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক ড. মো. সুলতান মাহমুদ ভূইয়া বলেন, আমাদের কাছে নির্দিষ্ট কোনো ডাটা নেই। তবে যারা নিয়মিত সমাবর্তনের আয়োজন করে না, তাদেরকে আমরা বরাবরই বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস হতে বলি। আমরা নিয়মিত ভিজিট করছি। সকল অনিয়ম প্রতিরোধে আমরা গুরুত্বের সাথে কাজ করছি।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এ তালিকায় আছে। কিন্তু সমস্যাটা এখনকার নয়। বিগত সরকারের আমলে অনেক গুলো বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগ বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির স্বার্থে। এগুলোর মান নেই। তারা সমাবর্তনের আয়োজন করার মতো পর্যাপ্ত কাঠামো কিংবা সক্ষমতা নেই।

আরো পড়ুন: নর্থ সাউথে স্বেচ্ছাচারী-দুর্নীতিপরায়ণ ট্রাস্টিদের পুনর্বাসন হচ্ছে?

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ আরো বলেন, সমাবর্তন করার আগে ইউজিসির অনুমোদন নিতে হয়। আমরা কতগুলো শর্ত পূরণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সমাবর্তনের অনুমোদন দেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা নামেই ইউনিভার্সিটি। কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতা পূরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের দায়িত্ব পালন কতটা করছে এ  বিষয় নিয়ে আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন আছে। তবে আমরা এগুলোকে মনিটরিং করছি, যারা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে কেবল তারাই সমাবর্তন আয়োজন করবে।

তিনি আরো বলেন, যারা শুধু নামেই বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচালিত হেচ্ছে, তাদের বিষয়ে আমরা কঠোর হব। তাদেরকে হয়ত রাতারাতি বন্ধ করে দেয়া সম্ভব না, তবে আমরা নতুন পরিকল্পনা তৈরি করছি। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সকল কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য তাদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া হবে। তবে নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের আগে আমরা অন্তত হাজার বার ভাবব।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence