২০১০ সালে কেড়ে নেওয়া হয় খালেদা জিয়ার বসতবাড়ি, পরে পাঠানো হয় জেলেও

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিত বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতির কঠিন পথচলায় হারিয়েছেন অনেক কিছুই। স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর দেশের ভয়াবহ রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে নিরেট গৃহবধূ খালেদা জিয়া রাজনীতিতে নাম লেখান। এরপর দীর্ঘ সংগ্রামী পথচলায় তিনি পেয়েছেন ‘দেশমাতা’, ‘দেশনেত্রী’ ও আপসহীন নেত্রীর মতো নানা উপাধি। তবে এই রাজনীতির পথেই তাকে উচ্ছেদ হতে হয়েছে স্বামী-সন্তানের স্মৃতিবিজড়িত চার দশকের বসতভিটা থেকে হারাতে হয়েছে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে, এমনকি দীর্ঘদিন কারাবাসেও থাকতে হয়েছে তাকে।

রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার শুরু ১৯৮২ সালে বিএনপিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে। প্রথমে তিনি হন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং সর্বশেষ চেয়ারপারসন। রাজনীতির মাঠে তিনি ছিলেন আপসহীন, দৃঢ় ও কঠোর মনোভাবাপন্ন।

২০০৮ সালের পর শেখ হাসিনার আচরণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে ব্যক্তিগত আক্রোশে রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় সেনানিবাসের বাড়িছাড়া হতে হয় খালেদা জিয়াকে, এমনকি বালুর ট্রাকে অবরুদ্ধ থাকতে হয় বাড়ির ভেতরে। শেষ পর্যন্ত যেতে হয় কারাগারেও।

খালেদা জিয়াকে ঢাকার সেনানিবাসের ৬, শহীদ মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ বাংলাদেশের রাজনীতির এক বিতর্কিত অধ্যায়। ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল তৎকালীন হাসিনা সরকারের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে বাড়িটির ইজারা বাতিল করে দাবি করে যে এটি নিয়মবহির্ভূতভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এরপর শুরু হয় দীর্ঘ আইনি লড়াই। কয়েক দফা স্থগিতাদেশ পেলেও ২০১০ সালের ১৩ অক্টোবর আদালত হাসিনার সরকারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। ফলে ১৩ নভেম্বর নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে বাড়িটি খালি করা হয়। ওই দিন কড়া নিরাপত্তা, উত্তেজনা, পরিবার ও সমর্থকদের কান্না—সব মিলিয়ে দিনটি পরিণত হয় আবেগঘন ও রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত এক ঘটনার দিনে।

এরপর গুলশানে সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া বলেন, তাকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে গাড়িতে তোলা হয়। তাকে ‘এক কাপড়ে’ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে এবং তিনি অপমানিত হয়েছেন।

আরও পড়ুন: জাতীয় পতাকায় মোড়ানো ফ্রিজিং ভ্যানে শেষবারের মতো ফিরোজায় যাত্রা খালেদা জিয়ার

তিনি অভিযোগ করেন, তার শোবার ঘরের দরজা ভেঙে টেনেহিঁচড়ে বের করে দেওয়া হয়। তার বক্তব্যে উঠে আসে, বিচারাধীন মামলা শেষ হওয়ার আগেই সরকারের এমন পদক্ষেপ আদালতের মর্যাদাকেও ক্ষুণ্ন করেছে। সে সময় দেশবাসী দেখেছে অশ্রুসিক্ত খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি ছাড়তে হয়েছে বাধ্য হয়ে। ১৯৭২ সালে জিয়াউর রহমান পরিবার নিয়ে ওই বাড়িতে ওঠেন এবং রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও সেখানেই থাকতেন। ১৯৮১ সালে তার মৃত্যুর পর ১২ জুন বাড়িটি ইজারা দলিলে খালেদা জিয়ার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের কথিত দুর্নীতির মামলায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয় নিম্ন আদালত। পরে উচ্চ আদালত তা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন—যা অনেকের মতে নজিরবিহীন। গ্রেপ্তারের পর তিনি পুরোনো কারাগার ও হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থায় বন্দী ছিলেন।

২০১৮ সালে কারাদণ্ডের পর তাকে রাখা হয় পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের মহিলা ওয়ার্ডে, যেখানে তিনি ছিলেন একমাত্র বন্দী। গুরুতর অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা তৈরি হয়। পরে করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয় এবং গুলশানের ‘ফিরোজা’তে ওঠেন তিনি। সেখানেও ছিলেন কার্যত বিচ্ছিন্ন। বিদেশে উন্নত চিকিৎসার আবেদনও বহুবার নাকচ হয়। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, এভাবেই তাকে ধাপে ধাপে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করা হয় এবং কারা নির্যাতনই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে তাকে সব দণ্ড থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর ২০২৫ সালের ৮ জানুয়ারি কাতারের আমিরের দেওয়া এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। সেখানে তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন এবং ছেলে তারেক রহমানের বাসায় থেকেছেন কিছুদিন। চার মাস পর দেশে ফিরে এসে আবারও শারীরিক জটিলতায় পড়েন। ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফেরার পর ছেলে তারেক রহমান প্রথমবারের মতো হাসপাতালে গিয়ে দেখা করেন মায়ের সঙ্গে। এরপর ৩০ ডিসেম্বর ভোর ৬টায় মারা যান খালেদা জিয়া—সমাপ্তি ঘটে তার ৭৯ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের।

এদিকে বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে আসছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকেই তাকে সেনানিবাসের বাড়িছাড়া, কারাবন্দী এবং চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয়। শেখ হাসিনার সরকার বিষয়টিকে আইনি প্রয়োগ হিসেবে দেখালেও বহু নাগরিক তা রাজনৈতিক আক্রোশ হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। তবে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর বদলে যায় দৃশ্যপট। দেড় দশকের নিপীড়নের অবসান ঘটে খালেদা জিয়ার জীবনে। কিন্তু তত দিনে তার শারীরিক অবস্থার অনেকটাই অবনতি ঘটে, এটি শেষ পর্যন্ত বেগম জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!