বিএনপি-জামায়াতের সেই ‘সখ্যতা’ এখন ‘শত্রুতা’, নেপথ্যে কী?
- মো. জাফর আলী
- প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:০৮ PM , আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৫৩ PM
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একটি তিক্ত সম্পর্ক বিরাজ করছে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মুহূর্তে দীর্ঘদিনের মিত্রতা থেকে এখন বৃহৎ এই দুই দলকে রাজনীতিতে অনেকটা ঘোর শত্রুতা নিয়ে একে অপরের সঙ্গে প্রতিপক্ষের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘর্ষেও জড়াতে দেখা যাচ্ছে তাদের নেতাকর্মীদেরকে। বর্তমান সময়ে এ প্রবণতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় নেতাকর্মীরা প্রাণও হারাচ্ছেন। এই মুহূর্তে প্রশ্ন উঠেছে, বন্ধুত্ব থেকে শত্রুতার দিকে কেন এই দু্ই দল? এর আগে কেমনই বা বন্ধুত্ব ছিল তাদের মাঝে?
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বার্থকে কেন্দ্র করেই বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই তারা নানা কৌশলে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। আর উভয়েই একে অপরের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় বিষয়টি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। তবে সহিংসতার ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে মনে করে তারা।
“মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক সুবিধাবাদের রাজনীতিই আজকের এই পরিস্থিতিতে এক সময়ের মিত্রকে শত্রুতে পরিণত করেছে।” - অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে দল দুটির ভাষ্য, রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতানৈক্য বা অঘটন ঘটে থাকে। তাদের মধ্যকার এ বিরোধ সেটিরই অংশ। এসব ঘটনাকে তারা সাময়িক হিসেবেও বিবেচনা করছেন।
গত ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর, এই এগারো মাসে কমপক্ষে ৮৫২ টি ‘রাজনৈতিক সহিংসতার’ ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১২৯ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৬ হাজার ৯৬৬ জন। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ পরায়ণতা, সমাবেশকেন্দ্রিক সহিংসতা, কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্থাপনা দখলকেন্দ্রিক অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ৮৫২ টি ঘটনার মধ্যে ৫৫টি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৫০৩ জন ও নিহত ২ জন। প্রতিনিয়ত দুই দলের মধ্যে এরকম সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
শুধু তাই নয়, দল দুটির শীর্ষ নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্যেও বিরোধ জোরালো হচ্ছে। তাছাড়াও, নেতাদের অনুরূপ কর্মীরাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন, এমনকি সংঘর্ষেও জড়াচ্ছেন।
গত ১১ নভেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, জামায়াতের টিকিট কাটলেই কি কেউ বেহেশতে যেতে পারবে? যারা এসব মুনাফেকি করে, তাদের কাছ থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
এরপর ২০ নভেম্বর খুলনায় এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছিলেন, বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলছে। তারা বর্তমানে মাহফিলে বাধা দেয়, মা–বোনদের তালিম প্রোগ্রামে বাধা দেয়। এটি করে তারা জামায়াতকে নয়, মূলত ইসলামকে বাধাগ্রস্ত করছে।
৫ আগস্ট পরবর্তীতে যুগের চাহিদায় নিজেদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে বিএনপির তেমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। যার কারণে, জামায়াত মানুষের কাছে বিএনপিকে আওয়ামী লীগের অনুরূপ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দল হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। - অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এরপর বিএনপি নেতারা জামায়াতের বিরুদ্ধে ধর্ম ব্যবহারের অভিযোগ তুলে কড়া ভাষায় তার জবাব দিয়েছেন। দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সম্প্রতি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জামায়াতের জন্য আওয়ামী লীগই ভালো ছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিরুদ্ধে ছিল, তারা এখন ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে।
এরপর শিবির নেতা ও ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমের ঠাকুরগাঁওয়ে দেওয়া এক বক্তব্যেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপি নেতাদের অনেকেই। তিনি তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, লন্ডন, দিল্লি, পিন্ডিতে বসে আর কোনো রাজনীতি চলবে না। নতুন বাংলাদেশের রাজনীতি— দেশেই হবে সিদ্ধান্ত।
বিভিন্ন তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখা যায়, ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট পাকিস্তানের (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত) লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ নামে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী। মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড মডেলে সৃষ্ট এ ইসলামী দলটির শাখাই হচ্ছে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’, পরে যেটির নাম হয় ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’।
“আমরা মনে করি, এগুলো সাময়িক, চূড়ান্ত নয়। কিন্তু আমরা আমাদের জায়গা থেকে সবসময় অপর পক্ষের রাজনীতিকে সম্মান জানাই এবং শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায়ে কাজ করার চেষ্টা করি। এটাই আমাদের নীতি। আমরা একে অপরের সঙ্গে সহানুভূতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখব, সেই নির্দেশনাই আমাদের নেতাকর্মীদেরকে দেওয়া আছে।” - সহকারী সহকারী জেনারেল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তানের বিভক্তি না চাইলেও ১৯৭১ সালে জামায়াত একক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম কিংবা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভক্তির বিরোধিতা করেছিল। যদিও তাদের দাবি, ভারতীয় আধিপত্যের আশঙ্কায় তাদের এ অবস্থান ছিল।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর নতুন সরকার জামায়াতকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং দলের নেতারা পাকিস্তানে নির্বাসনে চলে যান। পরে ১৯৭৫ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর এবং কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৭৭ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় (অর্থাৎ তিনি সব রাজনৈতিক দলকেই রাজনীতি করার সুযোগ দেন)। ফলে, দলটির নেতাকর্মীরা ফিরে এসে রাজনীতি করার অনুমতি পান এবং ১৯৭৯ সালের মে মাসে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবশালী নেতা আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এসময় থেকেই মূলত বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কের সূচনা।
“আগে বিএনপির সঙ্গে ছিল, এখন আলাদা। চলার পথে বিতর্ক বা রেষারেষি সৃষ্টি হবে, সেটা গণতন্ত্রে বড় কিছু নয়। বরং আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ ধরনের সংকট দূর হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।” - ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে ১৯৮১ সালে বিপথগামী কিছু সেনা কর্মকর্তা হত্যার পর ক্ষমতা দখল করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তার শাসনামলে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলাম অংশ নিলেও বিএনপি বিরত ছিল। এরপর ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত স্বৈরাচার এরশাদের বিতর্কিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি ও জামায়াতসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই বর্জন করেছিল। এসময় তারা একযোগে স্বৈরাচার সরকারের পতনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেন এবং অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। তবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোট থাকলেও কোনোটিতে অংশ নেয়নি জামায়াত, এককভাবে আন্দোলন করেছে।
এরপর ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জামায়াতের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম কর্তৃক উদ্ভাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠলে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয় জামায়াতের। এসময় জামায়াত ও আওয়ামী লীগ মিলে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অনীহার বিপরীতে ঘোর অবস্থান নেয়। পরে জামায়াতের সহযোগিতায় ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেও তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
আর ১৯৯৬ সালে বিএনপি ও জামায়াত আলাদা নির্বাচন করলে ভরাডুবি হয় জামায়াতের। তারা জেতে মাত্র তিনটি আসনে। এরপর বিএনপি ও জামায়াত দুই পক্ষই একে অপরের গুরুত্ব বুঝতে পারে। এ প্রেক্ষিতে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি ও জামায়াত চারদলীয় জোট গঠন করে। এই জোটের বিপরীতে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং চারদলীয় জোটের কাছে পরাজিত হয়। গঠিত সরকারে জামায়াতের দুজন শীর্ষ নেতা প্রথমবারের মতো মন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়: মির্জা ফখরুল
কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয় এবং এক পর্যায়ে তাদের মধ্যকার জোটও ২০২২ সালে ভেঙে যায়। অনেকে বলে থাকেন, ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তাদের মধ্যকার এই দুই দলের সম্পর্ক ছিল ‘মধুর’। এ সময়টাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখলেও যখন আওয়ামী লীগ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একের পর এক দণ্ড- এমনকি ফাঁসি দিতে থাকে, তখন বিএনপিকে পাশে পায়নি জামায়াত। এমনকি জামায়াতের ওই সব নেতার পক্ষে কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখায়নি জোটসঙ্গী বিএনপি। এতে হতাশ ও চরম ক্ষুব্ধ হয় দলটি। ফলে দূরত্ব বাড়তে থাকে।
এরপর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দলের মতবিরোধ আরও বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডনে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করলে জামায়াত তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে।
জামায়াতসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দাবি তুললে বিএনপি তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন বক্তব্য বা প্রচার-প্রচারণায় উভয় দলের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য, এমনকি সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়ানোর ঘটনাও প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে। তাছাড়াও, একে অপরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ট্যাগিং সংস্কৃতির চর্চার কারণেও এই দুই দলের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে।
এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সহকারী জেনারেল ও কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকবে। আমরা যার যার কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাব, এটাই নীতি এবং গণতন্ত্রের অংশ। রাজনীতির লক্ষ্য দেশ ও জনগনের সেবায় নেতৃত্ব দেওয়া। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি। কাজ করার মুহূর্তে এমন সময় আসতে পারে, যখন কিছু কিছু সমস্যা বা প্রতিপক্ষের সঙ্গে দুই-এক কথা বা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এবং টুকটাক সমস্যা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি, এগুলো সাময়িক, চূড়ান্ত নয়। কিন্তু আমরা আমাদের জায়গা থেকে সবসময় অপর পক্ষের রাজনীতিকে সম্মান জানাই এবং শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায়ে কাজ করার চেষ্টা করি। এটাই আমাদের নীতি। আমরা সবাই মিলে সুন্দর একটি দেশ বিনির্মাণে কাজ করব। এজন্য আমরা একে অপরের সঙ্গে সহানুভূতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখব, সেই নির্দেশনাই আমাদের নেতাকর্মীদেরকে দেওয়া আছে।
আরও পড়ুন: বিজয় দিবস উপলক্ষে জামায়াতের যুব ম্যারাথন শুরু
জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের জোট ছিল। প্রথমে ৪ দলীয়, পরে ১৮ ও ২০ দলীয় জোট ছিল। সেই জোট তো এখন নেই। প্রয়োজনে জোট হয়েছিল, আবার প্রয়োজনে ভেঙে গেছে। আগে যেমন সবাই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে ছিল, এখন তেমনি যার যার মতো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তিনি বলেন, জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল। এটি তার নিজের মতো করে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। আগে বিএনপির সঙ্গে ছিল, এখন আলাদা। চলার পথে বিতর্ক বা রেষারেষি সৃষ্টি হবে, সেটা গণতন্ত্রে বড় কিছু নয়। বরং আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ ধরনের সংকট দূর হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। সেজন্য ৫৪ বছরে অনেক ঘটনা আছে। সেগুলো পেরিয়ে আমরা ভালো কিছুর করার দিকেই যাব।
জোট থাকাবস্থায় জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী বা গণহত্যাকারী দল হিসেবে বিবেচনা না করলেও বর্তমানে বিএনপি নেতাকর্মীরা তা করছেন কেন এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এ নেতা বলেন, তখন জোটে ছিল এজন্য বলা হয়নি। এখন জোটে নেই তাই বলা হচ্ছে। আবার জোটে গেলে বলা হবে না। ঘরের বউ খারাপ থাকলেই কী কেউ খারাপ বলে? ৫৪ বছর আগে জামায়াত গণহত্যাকারী দল ছিল না। যদি কেউ তকমা নিজের থেকে অর্জন করে, সেটা কেউ বললে তো সমস্যা থাকার কথা নয়। এ তকমা তো তাদেরই প্রাপ্য।
দীর্ঘদিনের এই মিত্র দল দুটির শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্কের কারণ জানতে চাইলে রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে জামায়াত হয়ত মনে করছে, বিশেষ এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, যেখানে বৃহৎ দুইটি দলের একটির কার্যক্রম পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা আছে, অন্যটি শীর্ষ নেতৃত্বহীন, ক্ষমতায় যাওয়ার এমন সুবর্ণ সুযোগ হয়ত আর পাবেনা। ফলে, তারা চাইবেই যে-কোনো মূল্যে বিএনপিকে কোনঠাসা করতে।
আরও পড়ুন: আল-বদর নয়, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে পার্শ্ববর্তী দেশের লোকজন: বিএনপি নেতা
তিনি আরও বলেন, জামায়াত মূলত ম্যাকিয়াভ্যালিয়ান রাজনীতি করছে, যেখানে ধূর্ততা ও মাঠে শক্তি প্রদর্শন উভয় চেষ্টা সমান্তরাল রাখার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে, দলটির অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থককে আজকাল দেখা যাচ্ছে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বর্তমান চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে প্রায়ই নিষ্কলঙ্ক আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে।
তিনি বলেন, বিএনপি ও এর নেতাকর্মীসহ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নেতিবাচকভাবে ঢালাও উপস্থাপনও লক্ষণীয়। এমন কৌশল হয়ত সাম্প্রতিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোর ন্যায় বিএনপির ভোটব্যাংককে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
ঢাবির এই শিক্ষক মনে করেন, মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক সুবিধাবাদের রাজনীতিই আজকের এই পরিস্থিতিতে এক সময়ের মিত্রকে শত্রুতে পরিণত করেছে।
বিএনপির ভূমিকার বিষয়ে এ অধ্যাপক বলেন, বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে ছিল। ৫ আগস্ট পরবর্তীতে, শীর্ষ নেতৃত্বহীন এই দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজির বিষয়টি আলোচনায় আসে। অভিযোগসমূহ সফলতার সহিত মোকাবেলা করতে দলটি ব্যর্থ হয়েছে।
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী আরও বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তীতে যুগের চাহিদায় নিজেদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে বিএনপির তেমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। যার কারণে, জামায়াত মানুষের কাছে বিএনপিকে আওয়ামী লীগের অনুরূপ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দল হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জামায়াতের ক্ষমতামুখী উচ্চাভিলাষ জোরদার হচ্ছে। যদিও এ পর্যন্ত হওয়া প্রায় সকল জরিপে জনগণ বিএনপিকে এগিয়ে রাখছে। ফলে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থের দ্বন্দ্বই কখনো কখনো গড়াচ্ছে বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ ও সংঘর্ষে।