নীতির প্রশ্নে ভীষণ জেদি আর একগুঁয়ে ছিলেন হুমায়ূন স্যার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেটেছে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের এক স্বর্ণসময়। ছাত্রজীবনে থাকতেন মুহসীন হলে, শিক্ষকতা করেছেন রসায়ন বিভাগে। সপরিবারে থেকেছেন শহীদুল্লাহ হলের শিক্ষক কোয়ার্টারে। তাঁকে নিয়ে ছাত্র-সহকর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরের মনে জমা আছে অনেক গল্প। মৃত্যুর পর তাঁর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সেসব নিয়ে এই বিশেষ আয়োজন। হুমায়ূন আহমেদের নৈকট্য পেয়েছিলেন কেশব অধিকারী। কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর চরিত্রের নানা দিক। সে গল্পই এবার বলছেন তিনি-

ভর্তি হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার কোয়ার্টার থেকে সোজা চলে এলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে। হলের প্রভোস্ট তখন অধ্যাপক ড. মহব্বত আলী। আবেদন করলাম সিটের জন্য। তবে বিপত্তি ঘটল অনুমতি পাওয়ার পর। আমাকে ডেকে পাঠালেন ড. মহব্বত আলী। দুরুদুরু বুকে তাঁর রুমে গিয়ে হাজির হলাম। জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘ভুলটা আমাদেরই। এটা মুসলিম ছাত্রদের হল। তোকে জগন্নাথ হলে যেতে হবে।’ সাহস করে বলে ফেললাম, ‘কোথায় মুসলিম হল? আপনার কাগজে নেই, হলের গেটে আগে মুসলিম হল লেখা ছিল। এখন তো সেটা দেখছি উঠিয়ে দিয়েছেন।’ স্যার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তবে আমি বলে চলেছি, ‘এই হলটা আমার ভালো লেগেছে। এখানেই থাকব। আপনি ব্যবস্থা করুন।’ তিনি ধমকে উঠলেন, ‘তোর ভালোর জন্যই বলছি। মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে কুলিয়ে উঠতে পারবি না। তা ছাড়া আমাদেরও অসুবিধা আছে।’ কোনো ভাবান্তর নেই আমার, ‘সেসব আমি বুঝি না। তবে কার্জন হল এলাকা ছেড়ে নড়ছি না। এটাই স্যার আমার শেষ কথা।’

তোমার ছন্দের হাত ভালো, তবে

যথানিয়মে ক্লাস করছি। মহব্বত আলী স্যার ডেকে পাঠালেন ডিপার্টমেন্ট অফিসে। তিনি তখন আমাদের বিভাগীয় সভাপতিও। বললেন, বিকেলের মধ্যে যেন শহীদুল্লাহ হলে গিয়ে অধ্যাপক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করি। সঙ্গে সঙ্গে শুনে বেশ রোমাঞ্চিত হলাম। হুমায়ূন আহমেদ তত দিনে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক। প্রচুর নাম- ডাক। তাঁর বিভাগের ছাত্র হিসেবে আমরাও গর্বিত। বিকেলে হল অফিসে গেলাম স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। একটু ভয় ভয় লাগছে! হাজার হোক, ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক তো! দূর থেকে দেখেই বললেন- ‘কেশব নাকি? এসো, এসো!’ খানিকটা গম্ভীর গম্ভীর ভাব! ঠোঁটে সব সময়ের মতো সিগারেট! ব্যস্ত ভাব নিয়েই বললেন, ‘অধ্যাপক মহব্বত আলী তো তোমাকে নিয়ে ভীষণ বিপদেই পড়েছেন! তুমি আমার হলে, আমার ব্লকেই থাকবে।’ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। আমার দিকে একপলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অধ্যাপক নুরুল আমীনকে চেনো?’ উত্তরে বললাম, ‘হ্যাঁ চিনি, তিনি আমাদের ইনোরগ্যানিক প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে থাকেন।’ ওনার মতে, তোমাকে আরো একটু সাহসী হতে হবে! সাহসের কথা কেন বলেছিলেন, সেটা বুঝলাম যখন সিট বণ্টনের পর ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ’ নামের একটা ছাত্র সংগঠনের কিছু ক্যাডারের হাত থেকে সিট বুঝে নেওয়ার সময় এলো।

কাগজপত্রের কাজ শেষ করে বিদায় নেব, এ সময় বললেন- ‘তোমার ছন্দের হাত ভালো, তবে সুড়সুড়ির মাত্রাটা একটু বেশি, ওটা কমাতে হবে’! বুঝতে বাকি রইল না, ডিপার্টমেন্টে ঢুকেই ‘নবজাগরণ’ নামের যে দেয়ালপত্রিকা টাঙিয়েছিলাম, তা তাঁর নজরে এসেছে! আমার লেখা এত বড় একজন সাহিত্যিকের নজরে পড়েছে, শুনেই ভালো লাগল। বললাম, ‘জি স্যার, পরেরগুলো আপনাকে দেখিয়ে নেব।’

কেয়া বাআপস?

পরদিন সন্ধ্যায় এসে দাঁড়ালাম শহীদুল্লাহ হলের প্রধান ভবনের নিচতলায় সিঙ্গেল বেডের একটা রুমের সামনে। সামান্য খোলা দরজাটা, ভেতরে আড্ডা জমেছে কিছু একটা নিয়ে। কড়া নেড়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। আট কি ১০ জন ষণ্ডা প্রকৃতির ছেলে বসে আছে নানা ভঙ্গিতে। ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে গেছে ঘরটা। বিকট গন্ধ। বুঝলাম, আসর বসেছে গাঁজার! টকটকে লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একজন বলল, 'কেয়া বাআপস?' বললাম, 'স্যাররা তো এই রুমে আমায় থাকতে বলে পাঠালেন!' সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো বিশ্রী গালাগাল! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নেতা গোছের একজন খাটের তলার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, 'চালাতে পারবে?' নিচু হয়ে দেখলাম ১০-১২টি নানা আকারের আগ্নেয়াস্ত্র! সেই স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাবার হাতে একটা দোনলা বন্দুক ছাড়া তো ইহজনমে আর কোনো অস্ত্র দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এদিক-ওদিক মাথা নাড়িয়ে জানালাম-পারব না। শুরু হলো অশ্রাব্য খিস্তি-খেউর। কথা না বাড়িয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। সোজা চলে এলাম হলগেটের দরজায় বসা হুমায়ূন স্যারের কাছে। বললাম, 'স্যার দুটো আর্জি আছে। প্রথমত, আমাকে ডাবল সিটের রুমে দেবেন। দ্বিতীয়ত, এমন কারো কাছে পাঠাবেন না, যারা আদৌ ছাত্র নয়।' 'জানলে কী করে, এরা ছাত্র নয়?' জানতে চাইলেন স্যার। 'মুখের ভাষায়।' স্যারের পাশে বসা অধ্যাপক নুরুল আমীন বললেন, 'বলেছিলাম না, একে দিয়ে হবে না। ঠিক আছে, এক কাজ করো, পাশের ব্লকের ২০৪১-এ চলে যাও। ওখানে গণিতের আইনুল হক আছে। ওর সঙ্গে থাকো।' তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন স্যারের মুখে একরাশ বিরক্তি। উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। দুজন দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে সোজা চলে গেলেন ভেতরে। পেটরাসমেত পেছন পেছন চললাম ২০৪১-এর উদ্দেশে। এসে দেখি, দরজার একপাশে ছোট্ট এক টেবিলে হালকা গড়নের এক অতিনির্বিবাদী টাইপের বালক বালক চেহারার একজন অখণ্ড মনোযোগে গণিতচর্চায় মগ্ন! বুঝলাম, এই আইনুল। পরিচয় দিয়ে নুরুল আমীন স্যারের কথা বললাম। 'কোনো অসুবিধা নেই, যেকোনো একটা বিছানা গুছিয়ে নাও, অন্যটা আমি নেব।' বলল সে। জানালার ধারের বিছানাটা বেছে নিলাম।

ঠিক তখনই নিচ থেকে ভেসে এলো হুমায়ূন স্যারের গর্জন! ছুটে বারান্দায় চলে গেলাম দুজনেই। দেখি, স্যার সে রুমের দুজনকে বুকের কাছের কলার খামচে ধরে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে হলের গেটের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন! হঠাৎ মনে হলো, হালকাপাতলা গড়নের হুমায়ূন স্যারের খ্যাতিই এই সাহসের উৎস। কিন্তু ভুল ভাঙতে দেরি হলো না। স্যার নীতির প্রশ্নে ভীষণ জেদি আর একগুঁয়ে। অকুতোভয় এই শিক্ষকটিকে ডিপার্টমেন্টেও দেখেছি, নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজস্ব বিশ্বাস অবলীলায় প্রতিষ্ঠা করতে। একবার পরীক্ষা দিচ্ছি কার্জন হলে বসে। হঠাৎ মূল ডায়াস থেকে নেমে এক সারিতে বসা পাঁচ-ছয়জন ছাত্রের খাতা ছিনিয়ে নিয়ে আবার ডায়াসে ফিরে গেলেন হুমায়ূন স্যার। ঘোষণা দিলেন, সাধ্য থাকলে কাটা রাইফেল নিয়ে যেন খাতাগুলো তাঁরা ফিরিয়ে নিয়ে যায়! থেমে গেল পাতা উল্টানোর ছপাৎ ছপাৎ শব্দ। সবার চোখ চলে গেল হলের একটা বিশেষ দিকে! রক্তচক্ষে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে পাঁচ-ছয়জন ছাত্র, টেবিলের ওপর পড়ে আছে আধহাত লম্বা সরু জলের পাইপের মতো দু-তিনটা কালচে বস্তু! দু-তিন মিনিট অপেক্ষার পর ওরা বেরিয়ে গেল কোনো অঘটন ছাড়াই! পরে শুনলাম, ওগুলোই কাটা রাইফেল!

হুমায়ূন আহমেদের চামড়া তুলে নেব আমরা

শহীদুল্লাহ হলের প্রধান ভবনের গেটের পাশের ভবনটির দোতলায় থাকেন তিনি। এক সন্ধ্যায় চলে গেলাম স্যারের বাসায়। মেঝেতে বসে টি-টেবিল সাইজের নিচু একটা টেবিলে উপুড় হয়ে বসে একমনে লিখছেন। পরনে লুঙ্গি, খালি গা! মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে পাতাগুলো এগিয়ে দিচ্ছেন শীলার দিকে। মেজো মেয়ে পড়ে শোনাচ্ছে বাবাকে। উল্টোদিকের টেবিলে বসে অঙ্ক করছে শান্ত স্বভাবের নোভা। সোফায় বসে আছি আমি। হঠাৎ আঁতকে উঠলাম, দূর থেকে ভেসে আসছে মিছিলের স্লোগান, 'হুমায়ূন আহমেদের চামড়া, তুলে নেব আমরা!' ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখলাম, মিছিলটা ফজলুল হক হলের দিক থেকে এগিয়ে আসছে শহীদুল্লাহ হলের প্রধান ভবনের দিকে। মিছিল দেখে নিচের দিকে নেমে গেলেন স্যার। বারবার বললাম, যাবেন না। মেয়েরা বাবাকে ঠেকানোর জন্য কান্নাকাটিও করল। কারো কথাই শুনলেন না। নেমে গিয়ে দাঁড়ালেন মেইন গেটের সামনের কাঁটা গাছে ঘেরা ফ্ল্যাগহোস্টিংয়ের সামনে। কাছে এগিয়ে আসতেই হাত তুলে মিছিলকারীদের বললেন, 'এদিকে আসো তোমরা, কে কে আমার চামড়া তুলতে চাও!' সামনের সারির ছেলে-ছোকরারা তো একেবারেই হতভম্ব! ভাবতেই পারেনি, স্যার এভাবে সামনে এসে দাঁড়াবেন। আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তাঁর চামড়া তুলতে ডাকছেন! কে মুখ লুকাবে কার পেছনে, সে যে প্রতিযোগিতা সেদিন দেখেছিলাম, আজও মনে আছে স্পষ্ট! পাঁচ মিনিটের মধ্যে জঙ্গি মিছিলটা উধাও। স্যার ওপরে উঠে এলেন।

কেশব একটু দাঁড়াও

শহীদুল্লাহ হলে আমাদের বার্ষিক ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হচ্ছে। নাম জমা দিয়েছি উপস্থিত বক্তৃতায়। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন হুমায়ূন আহমেদ! লটারিতে ভাগ্যে জুটল 'আমার প্রিয় মানুষ'। ভাববার সময় পেলাম দুই মিনিট! ডায়াসের সামনে মাইক্রোফোন হাতে খানিকটা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে গড় গড় করে বলে গেলাম প্রয়াত শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল আমীনের কিছু স্মৃতিগাথা। যিনি মারা গেছেন গত বছর। বক্তৃতা শেষে স্টেজ থেকে নেমে সোজা রওনা হলাম মধুর ক্যান্টিনের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছি বেশ খানিকটা, মনে হলো ওপর থেকে কেউ দ্রুত নেমে আসছে। পেছন ফিরে দেখি, ছুটে আসছেন হুমায়ূন স্যার, 'কেশব, একটু দাঁড়াও।' আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'আজকের এই প্রতিযোগিতায় তুমিই শ্রেষ্ঠ বক্তা, আমি বিচারক হলে, তোমাকেই শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত করতাম! খুব খুশি হয়েছি।'

আমার জর্জ হ্যারিসন

বিয়ের খবর যখন জানালাম, স্যার তুমুল ব্যস্ত টিভি নাটক নিয়ে। বললেন, 'তোমার জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে বাসায় এসো।' জর্জ হ্যারিসন আমার বউ! প্রিয় শিল্পীর নামে ওকে ডাকতাম। কদিন পর এক সন্ধ্যায় এলিফ্যান্ট রোডের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছি। স্যার কম্পিউটারে টাইপ করছেন। উঠে চলে গেলেন ভেতরের ঘরে। ফিরে এসে নাম ঠিকুজির খোঁজ নিতে গিয়ে বললেন, 'এই মেয়ে, তোমার গলাটা এত ভারী কেন হে? আদা আর মধু খাবে।'

আরেক দিন আমি আর জর্জ হ্যারিসন গিয়ে দেখি, পারিষদবর্গ সমেত স্যার নিত্যদিনের আড্ডায় ব্যস্ত! ড্রয়িংরুমটা খোলা হলঘরের মতো, সোফা বা চেয়ার নেই। মাটিতে ঢালা বিছানা পাতা! দেয়ালে ঠেস দেওয়া সারি সারি বড় বড় বালিশ। কেউ কোলে, কেউ-বা বালিশ পিঠে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন! আড্ডা মানে নানা ধরনের অদ্ভুত কাহিনী আর ঘটনার জমজমাট বিশ্লেষণ! বরাবরের মতো স্যারই মধ্যমণি। ভেতর থেকে খানিক বাদে বাদে ট্রেতে করে চায়ের সরবরাহ এসে পৌঁছুচ্ছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন খালেদা জিয়া। একসময় স্যার জানালেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পিএস স্যারকে ফোন করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর উপন্যাসের একান্ত ভক্ত! আমাকে বললেন, 'আমার এ পর্যন্ত প্রকাশিত সব উপন্যাসের দুটি সেট উপহার হিসেবে কেমন হয়? আমি তো একজন লেখক। একজন লেখকের সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে আপন আর সবচেয়ে বড় তো তার সৃষ্টি, তাই না?'

(লেখাটি মুক্তমনা ব্লগ থেকে নেওয়া, ঈষৎ সংক্ষেপিত)


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence