গাজায় কেন গণহত্যা ঠেকাতে পারছে না জাতিসংঘ?
- শন ম্যাথিউস
- প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:১৩ PM
১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সশস্ত্র শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা হয়। তাদের গন্তব্য ছিল সিনাই ও গাজা উপত্যকা, যা তখন মিশরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেখানে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের যৌথ আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
ফিলিস্তিনের গাজায় যখন ইসরায়েলি নৃশংসতা যখন চরমে, তখন জাতিসংঘ ৮০তম সাধারণ অধিবেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এখন গাজার জন্য কী করতে পারে জাতিসংঘ। কেন তারা বেশি কিছু করতে পারছে না?
যদিও সুয়েজ সংকট ও গাজার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাতিসংঘের বিশেষ বাহিনীর মোতায়েন এখনকার সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়, বিশেষ করে তারা কীভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে।
বহু আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ও গবেষক বলছেন, গাজায় যা চলছে, তা গণহত্যা। এরপরও গাজায় চালানো ইসরায়েলের আক্রমণকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কমপক্ষে ছয়বার ভেটো দিয়েছে দেশটি। এতে যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের আহবান জানিয়ে তোলা প্রস্তাবগুলো আটকে গেছে।
১৯৫৬ সালেও এভাবে নিরাপত্তা পরিষদ অচল ছিল। কারণ তখন দুই পরাশক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করত। তখন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৫০ সালের ‘শান্তির পক্ষে ঐক্য’ প্রস্তাব ব্যবহার করে নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে সেখানে শান্তিরক্ষী পাঠায়।
জাতিসংঘ সনদের অধ্যায়-৭ অনুযায়ী শান্তিরক্ষী পাঠানো ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষমতা আছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের হাতে। ১৯৫৬ সালে সাধারণ পরিষদের পক্ষে একটি বড় শক্তি কাজ করেছিল, তা হলো– যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় সমর্থন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইসরায়েলের চালানো যৌথ আক্রমণের বিরোধিতা করেছিলেন।
জাতিসংঘের তৎকালীন সাহসী মহাসচিব ড্যাগ হ্যামারশোল্ড অনেক দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে শান্তিরক্ষীদের মোতায়েনের জন্য সম্মতি আদায় করেন, তখন মিশরও বিষয়টি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এখন গাজাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে রাজি নন।
এখন গাজার জন্য শিক্ষা হলো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কৌশল থাকলে পরিষদ নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে সাধারণ পরিষদ। যদিও শেষ পর্যন্ত সদস্য দেশগুলোর সদিচ্ছার ওপরই নির্ভরশীল জাতিসংঘ।
গণহত্যা
গণহত্যা রোধে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাস তেমন একটা গৌরবজনক নয়। সর্বোচ্চ বললে জাতিসংঘের রেকর্ড মিশ্র বলে মনে করেন মার্টিন শ। তিনি সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক ও গণহত্যা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। রুয়ান্ডা ও বসনিয়ার গণহত্যার ক্ষেত্রে কেবল ঘটনার পরেই বিষয়চি আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যা বলে স্বীকার করে জাতিসংঘ।
রুয়ান্ডার ক্ষেত্রে এ ব্যর্থতা আরও জোরালো ছিল। সেখানে হালকা অস্ত্রসহ মোতায়েন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কমান্ডার রোমিও ডালেয়ার বারবার সতর্ক করেছিলেন, গণহত্যা হতে পারে। কিন্তু জাতিসংঘ তখন কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল।
৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলের দক্ষিণাংশে আক্রমণের পর গাযায় ইসরায়েলের আক্রমণে অন্তত ৬৫ হাাজর ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু বলে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে। পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
গাজায় বোমাবর্ষণ ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করে নতুন আবাসন ও বসতি স্থাপনের কথা প্রকাশ্যে বলেছেন ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সংক্রান্ত জাতিসংঘের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা মঙ্গলবার জানিয়েছে, গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এটাই এ পর্যন্ত সংস্থাটির সবচেয়ে বড় ঘোষণা।
মার্টিন শ বলেন, এ দিক থেকে গাজার গণহত্যা অন্যসব ঘটনা থেকে আলাদা। গাজা আলাদা কারণ এখানে জাতিসংঘ দেরিতে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে এ গণহত্যায় অংশীদার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দু’টি কারণে জাতিসংঘ গণহত্যা থামাতে ব্যর্থ হয়: প্রথমত বড় বা ছোট শক্তিগুলোর বিদেশি দেশের ভূমিতে হস্তক্ষেপে আগ্রহ কম। যেমন, সুদানের দারফুরে ২০০০ সালের দিকে সরকার ও জানজাওয়িদের মধ্যে সংঘটিত গণহত্যার সময় দেখা যায়।
আরও পড়ুন: এবার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে পর্তুগাল
দ্বিতীয়ত দারফুরে গণহত্যা চলছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে ২০০৪ সালে। তবে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সে সময় কয়েকশ শান্তিরক্ষী পাঠায় আফ্রিকান ইউনিয়ন। কিন্তু ২০০৬ সাল পর্যন্ত কোনো মিশন অনুমোদন করেনি জাতিসংঘ।
বিভক্ত সাধারণ পরিষদ
প্যারিসের সেন্টার থুসিডিদ-এ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্সান্দ্রা নভোসেলফ বলেন, ‘এটি জাতিসংঘের ব্যর্থতা নয়, বরং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতা। জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা, শান্তিরক্ষী বাহিনী, দেশগুলোর জোট তৈরির মতো সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে, কিন্তু সে সিদ্ধান্ত সদস্যদের ওপর নির্ভর করে।
তার ভাষ্য, ফ্রান্স ও সৌদি আরব সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রস্তাব আনতে যাচ্ছে। কিন্তু গাজা নিয়ে এ পর্যন্ত সাধারণ পরিষদে কোনো শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কারণ সাধারণ পরিষদের সদস্য দেশগুলো বিভক্ত।
ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ক্ষমতাধর দেশগুলোর সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া জাতিসংঘের পক্ষে গণহত্যা থামানো কঠিন। ১৯৯৫ সালে বসনিয়ায় স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার পর যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় হয়েছল। জাতিসংঘ আগে থেকেই সার্বিয়ার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু মুসলিম বসনিয়ানদের হত্যা ঠেকানো যায়নি। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বসনিয়ান মুসলিম ও খ্রিস্টান ক্রোয়াটদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে এবং ন্যাটো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি নিয়ে সার্বিয়ায় বিমান হামলা চালায়।
ক্যাটো ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ডগ ব্যান্ডো মনে করেন, গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতার জন্য জাতিসংঘ দায়ী নয়। বরং এ জন্য দায়ী ইসরায়েলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। তারা রুয়ান্ডা, সুদান বা লাইবেরিয়ায় গণহত্যা থামাতে পারেনি। ফলে গাজায় যা চলছে, তা থামাতে পারবে এমন আশা করা যায় না।
গাজার চলমান ঘটনার জন্য প্রায় সব দোষ যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখ করে তিনি বলেন, একদিকে তারা ইসরায়েলকে অস্ত্র দেওয়াসহ নানাভাবে সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে জাতিসংঘকেও পদক্ষেপ নিতে বাধা দিচ্ছে।
(মিডল ইস্ট আই থেকে লেখাটি অনুবাদ করা)