রাষ্ট্রপতি থেকে সর্বোচ্চ নেতা: ৬ রাষ্ট্রপতির কমান্ডার আলী খামেনির গল্প
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ০৭:৩০ PM , আপডেট: ২৫ জুন ২০২৫, ১০:১২ PM
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইরানের শাসনব্যবস্থা অনেকটাই আলাদা। দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, প্রেসিডেন্ট ও সংসদ সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন, তবে দেশের মূল ক্ষমতা থাকে একজন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার হাতে। এই গুরুত্বপূর্ণ পদে গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে রয়েছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।
সম্প্রতি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনার সময়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, আয়াতুল্লাহ খামেনির জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে। এমনকি মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মন্তব্য করেন, খামেনি কোথায় লুকিয়ে আছেন তিনি জানেন, তবে তাকে এখনই হত্যা করা হবে না। এ থেকে প্রশ্ন উঠেছে, কেন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান নয়, বরং আয়াতুল্লাহ খামেনি যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র উৎখাত হওয়ার পর ধর্মীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় থেকে দেশটিতে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এরপর থেকে দেশটি পেয়েছে মাত্র দুইজন সর্বোচ্চ নেতা—প্রথমে আয়াতুল্লাহ খোমেনি এবং তার মৃত্যুর পর আলী খামেনি।
আয়াতুল্লাহ খামেনি বর্তমানে ইরানের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ। পারমাণবিক নীতিমালা, বিদেশনীতি, এমনকি জাতিসংঘের পরমাণু সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়েও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তার হাতে। গত কয়েক সপ্তাহে ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষে দেশটির শীর্ষ সামরিক নেতা ও পরমাণু বিজ্ঞানীরা নিহত হয়েছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, যদি খামেনির মৃত্যু ঘটে বা তাকে হত্যার চেষ্টা সফল হয়, তাহলে তার উত্তরসূরি হবেন কে?
১৯৩৯ সালে উত্তর-পূর্ব ইরানের মাশহাদ শহরে জন্ম নেওয়া আলী খামেনি একজন ধর্মীয় পণ্ডিতের সন্তান। স্থানীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা শেষে তিনি কোম শহরে যান, যা শিয়া মুসলিমদের কাছে একটি পবিত্র নগরী। সেখানে তিনি আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন ধর্মীয় আন্দোলনে যুক্ত হন।
১৯৬২ সালে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসন বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন খামেনি। এজন্য একাধিকবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর তিনি বিপ্লবী পরিষদে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন এবং ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (IRGC) গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৮১ সালে তেহরানের একটি মসজিদে বোমা হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন এবং তার ডান হাত আংশিকভাবে অকেজো হয়ে পড়ে। একই বছরের আগস্টে বিদ্রোহীরা রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ-আলী রাজাইকে হত্যা করলে, তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন আলী খামেনি। আট বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার সঙ্গে সংস্কারপন্থী প্রধানমন্ত্রী মির হোসেইন মুসাভির মতবিরোধ দেখা দেয়।
১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর ইরানের সংবিধান সংশোধন করে আলী খামেনিকে সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে নিয়োগ দেয় বিশেষজ্ঞ পরিষদ। তখন তিনি ‘গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ’ ছিলেন না, তাই তার জন্য সংবিধান সংশোধন করে তাকে 'হোজ্জাতুল ইসলাম' থেকে 'আয়াতুল্লাহ' পদবীতে উন্নীত করা হয়।
এরপর থেকে ইরানের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন আয়াতুল্লাহ খামেনি। তার শাসনামলে ছয়জন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব পালন করেছেন, যাদের মধ্যে অনেকে তার নীতির সঙ্গে মতানৈক্যে জড়ালেও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কাঠামো কখনও চ্যালেঞ্জ করেননি।
১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সংস্কারপন্থী মোহাম্মদ খাতামি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়েও খামেনি তার বিভিন্ন উদ্যোগে বাধা দেন। এরপর আসেন রক্ষণশীল মাহমুদ আহমাদিনেজাদ, যিনি প্রথমদিকে খামেনির ঘনিষ্ঠ মনে হলেও পরে অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তার সঙ্গে মতবিরোধে জড়ান।
২০০৯ সালে আহমাদিনেজাদের বিতর্কিত পুনঃনির্বাচনের বিরুদ্ধে ইরানে ব্যাপক আন্দোলন হয়। খামেনি ফলাফল বৈধ ঘোষণা করে আন্দোলন দমনে কঠোর নির্দেশ দেন। এতে বহু মানুষ নিহত ও হাজারো বিরোধী কর্মী গ্রেফতার হন।
২০১৩ সালে উদারপন্থী হাসান রুহানি প্রেসিডেন্ট হয়ে পরমাণু চুক্তি সম্পাদন করেন, যার পেছনে খামেনির সম্মতি ছিল। কিন্তু রুহানির নাগরিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রচেষ্টায় তিনি বাধা দেন। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে সরে গিয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট ও বিক্ষোভ শুরু হয়।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন হামলায় জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করলে খামেনি প্রতিশোধের ঘোষণা দেন। ইরাকে অবস্থিত দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। এই সময় খামেনি বলেছিলেন, এটি "আমেরিকার গালে চপেটাঘাত।"
একই বছর, আইআরজিসির ভুলে ইউক্রেনের একটি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত হলে ১৭৬ জন মারা যান। শুরুতে সরকার ঘটনাটি গোপন করার চেষ্টা করে, ফলে দেশজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তবু খামেনি সামরিক বাহিনীর পক্ষ নেন এবং জনগণের ক্ষোভকে "শত্রুর ষড়যন্ত্র" বলে আখ্যা দেন।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে খামেনি এটিকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, এটি ইরানের শত্রুদের একটি ষড়যন্ত্র। কিন্তু পরবর্তীতে ভাইরাসটি মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
২০২১ সালে খামেনির ঘনিষ্ঠ ও কট্টরপন্থী এব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ধারণা করা হচ্ছিল, তিনিই হবেন খামেনির উত্তরসূরি। তবে ২০২৪ সালের ১৯ মে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় রাইসি নিহত হন। এরপর জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সংস্কারপন্থী নেতা মাসুদ পেজেশকিয়ান।
আয়াতুল্লাহ খামেনির বয়স এখন প্রায় ৮৬ বছর এবং তিনি দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, তার মৃত্যু বা পদত্যাগের পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হবেন কে?
ইরানে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নির্বাচিত হন 'অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস' নামে পরিচিত একটি পরিষদের মাধ্যমে। এই পরিষদে ৮৮ জন ধর্মীয় নেতা থাকেন, যাদের নির্বাচন হয় প্রতি আট বছর অন্তর। তবে তাদের মনোনয়নের অনুমোদন দেয় ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’, যার সদস্যদের সরাসরি বা পরোক্ষভাবে নিয়োগ করেন খামেনি নিজেই। ফলে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে নিশ্চিত করেছেন যে এই পরিষদে তার অনুগতরাই থাকবেন।
আসন্ন সময়ে খামেনির মৃত্যু বা পদত্যাগের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ পরিষদই পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতাকে বেছে নেবে। তবে এই পদের জন্য যোগ্য হতে হলে প্রথাগতভাবে একজন ‘আয়াতুল্লাহ’ বা শীর্ষস্থানীয় শিয়া ধর্মীয় নেতা হতে হয়—যদিও খামেনির ক্ষেত্রে এ নিয়ম শিথিল করা হয়েছিল।
ইরানের ইতিহাসে আয়াতুল্লাহ খামেনি দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে দীর্ঘকালীন সর্বোচ্চ নেতা। তার উত্তরসূরি কে হবেন তা শুধু ইরানের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও প্রভাবিত করবে।
সূত্র: বিবিসি।