ছাত্রী হলের নীতিমালা প্রগতিবিরোধী ও অপমানজনক
- সাদ্দাম হোসেন
- প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ০২:৫৩ PM , আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ০২:৫৩ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলের আবাসিকতার ক্ষেত্রে বিবাহিত ছাত্রীদের বিষয়ে বিদ্যমান নীতিমালা বা বিধিনিষেধকে আমরা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, প্রগতিবিরোধী, নারীদের জন্য অপমানজনক এবং সার্বিকভাবে শিক্ষাবিরোধী মনে করি। শিক্ষার্থী পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত একাডেমিক, আবাসিক ও অপরাপর কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে হবে, অন্য কোন ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বা জীবনাচারের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যে কোন বিচারেই যুক্তিবিরোধী ব্যাপার।
কে বিবাহিত, কে বিবাহিত নয় কিংবা স্বাধীনভাবে কে কোন ভাবে কি ধরনের সম্পর্কে আবদ্ধ- এসব মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত পরিসর। সে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে কিংবা অন্য লিঙ্গের। ব্যক্তিগত পরিসরের আলোকে সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত কাম্য নয় এবং যুগ যুগান্তরের লড়াইয়ের ফলাফল হিসেবে আমরা যেসব মূল্যবোধ অর্জন করেছি সেসব কোনভাবেই ফেলনা হতে পারে না। এক অর্থে তাই বিবাহিত হওয়ার কারণে সিট বাতিল বা শর্ত আরোপ বা বিধিনিষেধ দেয়া মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতাবিরোধী এবং এটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেয়।
আরেক অর্থে, শিক্ষার্থী হিসেবে না বিবেচনা করে ব্যক্তিগত পরিসরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা একধরনের নীতিপুলিশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নীতিপুলিশিকে প্রশ্রয় দেয়া নয়, রক্ষণশীলতার মোড়লিপনা করা নয়, প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য হওয়া চাই এবং এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে পরিবর্তনকে আত্মস্থ করা উচ্চশিক্ষারই ধর্ম। আবাসন সংকটের দায় প্রশাসনের এবং এর জন্য তথাকথিত তুলনামূলক বাছবিচারের কথা বলে কাউকে ভুক্তভোগী করার অধিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেই।
আরও পড়ুন: ঢাবির ছাত্রী হলে থাকতে পারেন না বিবাহিতরা
বর্তমান নিয়ম শিক্ষাবিরোধী এ কারণেই যে সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতায় বিয়ের ফলে যে কোন নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হওয়ার আশংকা থাকে, নারী শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক প্রত্যাশা, পঠন-পাঠন বিঘ্নিত হতে পারে। এ সময় বরং একজন মেয়ের জন্য বাড়তি নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা প্রয়োজন যাতে করে বিশ্ববিদ্যালয় সংবেদনশীলভাবে তার জন্য উচ্চশিক্ষার পরিবেশ ও চাহিদা অক্ষুণন রাখতে পারে।
আরও পড়ুন: ছাত্রীরা হলে থাকতে না পারলে যাবেন কোথায়, সাদ্দামের প্রশ্ন
আরেকটি বিষয় হল, এ ধরনের প্রথা ছেলেদের সাথে কিংবা অন্যান্য মেয়েদের সাথে তুলনা করলে আইনের দৃষ্টিতে সমতাকে সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করে। এটি নারীবিরোধী নিয়মও বটে। সমাজের অন্যান্য স্তরে লিঙ্গীয় পরিচয়ের কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম হওয়া, পারিশ্রমিক কম পাওয়ার মত বিবাহিত হওয়ার কারণে বা স্বাধীনভাবে জীবনাচার বেছে নেওয়ার কারণে কিংবা প্রজনন স্বাস্থ্যগত বাস্তবতায় কারো অধীকার সীমিত করা নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকতা হিসেবেই বরং কাজ করে।
আরও পড়ুন: ছাত্রী হলের বিধানটি এখনই বাতিল করা সম্ভব নয়: ঢাবি ভিসি
আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিদ্যমান নিয়ম বাতিল করে যুগোপযোগী, আধুনিক, যৌক্তিক, ন্যায়সম্মত, প্রাগ্রসর, সমতাবাদী নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছি। প্রত্যাশা করছি, আজকের প্রভোস্ট কমিটির মিটিং এ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হবে। এবং এখানেই শেষ নয়। আমাদের লড়াইও শেষ হয়ে যায়নি। এমন দিন আমাদের বিনির্মাণ করতে হবে যখন সমাজের প্রত্যেকটি স্তরে, জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষণে ছেলে মেয়ের সমতা নিশ্চিত হবে, লিঙ্গীয় বৈষম্য দূর হবে, মানুষ পরিচয়েই নির্ধারিত হবে পৃথিবীর সবকিছু।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল ৬টা-রাত ১০ টায় ব্র্যাকেটবন্দী থাকবে না নারীদের অধিকার, ছেলেদের হল ও মেয়েদের হলের সুযোগ-সুবিধা-অধিকারের পরিসরে পার্থক্য থাকবে না, শিক্ষার্থী হিসেবেই নির্ণীত হবে সমস্ত নিয়মকানুন, ২৪ ঘণ্টা উন্মুক্ত থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, মিছিলে কিংবা সেমিনারে কিংবা কনসার্টে 'শোভাবর্ধক' হিসেবে সামনে বা আলাদা নয়, সংরক্ষিত স্থানেও নয়, আমাদের সারথি হিসেবে সমান্তরালেই সবাই থাকবে হাতে হাত রেখে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে। ততদিন জারি থাকুক আমাদের লড়াই।
লেখক: ডাকসুর সাবেক এজিএস