করোনা-কালে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্ব দিতে হবে
- মুহাম্মাদ তানবীরুল ইসলাম
- প্রকাশ: ২২ জুন ২০২০, ০৪:১৩ PM , আপডেট: ২২ জুন ২০২০, ০৪:১৩ PM
করোনাভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবীতে সব কিছু হঠাৎ করে যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান বাধ্যতামূলকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে লকডাউন দেয়া হচ্ছে। এমতাবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বন্ধ থাকার ফলে সেশনজটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি আগামী বছর পর্যন্ত ক্লাসসমূহ পুরোপুরি অনলাইন করে দিয়েছে। বাংলাদেশ তথ্য প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত বিশ্বের মতো সমৃদ্ধ না হওয়ার ফলে এখানে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে কিছুটা বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আমরা আমাদের মতো করে কিছু স্ট্রাটেজি অনুসরণ করে এই বিষয়টিকে কাটিয়ে উঠতে পারি। আমরা জানি যে বর্তমানে বাংলাদেশ অধিকাংশ জায়গায় তৃতীয় প্রজন্মের নেটওয়ার্ক ও অনেক এলাকায় চতুর্থ প্রজন্মের নেটওয়ার্ক বিদ্যমান রয়েছে। যেহেতু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষার্থী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করছে, তাদের অনেকেই থ্রিজি বা ফোরজি নেটওয়ার্কের সুবিধা পাচ্ছে না। তাই তাদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি।
লাইভ ক্লাস বনাম রেকর্ডেড ক্লাসঃ
যারা সরাসরি অনলাইনে সংযুক্ত থাকতে পারে তাদেরকে নিয়ে অনলাইন লাইভ ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। এর সুবিধা হল এখানে একজন শিক্ষক সরাসরি ছাত্রদের ক্লাস নিতে পারেন, ছাত্র-ছাত্রীরা সরাসরি প্রশ্ন করতে পারে এবং তিনি তার উত্তর দিতে পারেন। বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে এ কাজটি সহজভাবে সম্পাদন করা যায়। যেমন- ফেসবুক লাইভ, Zoom, Google Meet, Skype, WhatsApp ইত্যাদি।
তবে এর অসুবিধা হচ্ছে যেসকল শিক্ষার্থী থ্রিজি বা ফোরজি নেটওয়ার্কের সুবিধা পাবে না তারা লাইভ ক্লাসে ঠিকমতো আলোচনা শুনতে ও বুঝতে পারবে না। লাইভ ক্লাসের আরেকটি অসুবিধা হলো যে একটি নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষক ও সকল শিক্ষার্থীকে উপস্থিত থাকতে হয়। যদি সবাই ইন্টারনেটের স্পীডের সুযোগ পায়, তাহলে এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। যেমন, আমরা সবাই বাড়িতে বসেই ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে শিক্ষকের সাথে টিউটোরিয়াল ক্লাস করেছি।
অপরদিকে, রেকর্ডেড ক্লাস আমাদের সবার জন্য ইনক্লুসিভ হতে পারে। এর সুবিধাটা হচ্ছে একজন শিক্ষক তার সময় মত ক্লাস রেকর্ড করে সেটি শেয়ার করে দিবেন এবং শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধামতো সময়ে সেগুলো ডাউনলোড করে বাসায় সুবিধামত দেখে নিতে পারবে।
রেকর্ডেড ক্লাস করার জন্য বাড়তি কোনো ঝামেলা নেই। যাদের বাড়িতে নেটওয়ার্কের স্পিড এর সমস্যা রয়েছে তারা যে জায়গাতে নেটওয়ার্ক স্পিড ভালো পাওয়া যায় সেখানে গিয়ে ক্লাসগুলো ডাউনলোড করে বাসায় নিয়ে এসে সুবিধা মত দেখতে পাবে। যেমন, গ্রামে যারা আছে তারা সাধারণত দুই-তিন দিন পর পর বাজারে গিয়ে বাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসে। আর মফস্বল এলাকার বাজারের মধ্যে নেটওয়ার্ক অপারেটরগুলোর টাওয়ার বসানো থাকে। ফলে সেখানে নেটওয়ার্ক স্পিডের পরিপূর্ণ কাভারেজ পাওয়া সম্ভব। শিক্ষার্থীরা যখন প্রয়োজনীয় কাজে বাজারে যাবে তখন লেকচার গুলো ডাউনলোড করে বাসায় নিয়ে এসে পড়তে পারবে। তবে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা থাকবে তাদেরকে হয়তোবা তুলনামূলকভাবে বেশি দূরত্বে (হতে পারে কয়েক কিলোমিটার) দূরে গিয়ে থ্রিজি বা ফোরজি নেটওয়ার্ক কাভারেজ পাবে। তাদের সংখ্যাটা তুলনামূলকভাবে কম।
আর ক্লাস রেকর্ড করার জন্য অল্প কিছু টেকনিক্যাল জ্ঞান থাকলেই যথেষ্ট। মোবাইল ফোন অথবা ল্যাপটপে রেকর্ড অপশন চালু করে দিলেই বক্তব্য রেকর্ড করা শুরু হবে এবং পরবর্তীতে সেটি ইউটিউবে বা গুগল ড্রাইভে আপলোড করে দিলেই হয়ে যাবে।
যদি কোন শিক্ষক পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন সহকারে ক্লাস নিতে চান তাহলেও তিনি তা করতে পারবেন। যেকোনো একটি স্ক্রিন রেকর্ডার সফটওয়্যার ডাউনলোড করে ইন্সটল করে দিলেই কাজ মোটামুটি শেষ। স্ক্রিন রেকর্ডার চালু করে ল্যাপটপে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বের করে কথা বলা শুরু করলেই কথা ও স্লাইড একই সাথে রেকর্ড হয়ে যাবে। রেকর্ড করার পর ফাইলটি ইউটিউবে বা গুগল ড্রাইভে আপলোড করে দিলেই শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে সেখান থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারবে।
উল্লেখ্য যে, ইউটিউবে বা গুগল ড্রাইভে প্রাইভেসি অপশন রয়েছে। আপলোড করার সময় প্রাইভেসি অন করে দিলে সেটি সার্চ দিয়েও প্রকাশ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে লিংক থেকে শেয়ার করা হবে শুধুমাত্র ওই লিংক ছাড়া ভিডিও লেকচারগুলো কেউ দেখতে পারবে না। ফলে এটি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
ফেসবুক গ্রুপঃ
ফেসবুকে একটি প্রাইভেট গ্রুপ খুলে সেখানে ছাত্রছাত্রীরা ও শিক্ষক মহোদয়গণ সংযুক্ত থাকবেন। কোন একজন শিক্ষক ক্লাস আপলোড করার পরে লিংকটি গ্রুপে শেয়ার করে দিবেন এবং ক্যাপশনে ক্লাসের ক্রমিক নম্বর উল্লেখ করে দিবেন। ক্লাস করার পরে কোন শিক্ষার্থী যদি প্রশ্ন থাকে তাহলে সেই পোষ্টের কমেন্টে প্রশ্নটি করতে পারবে। শিক্ষক পরে ওই প্রশ্নের কমেন্টে উত্তরটি দিয়ে দিবেন। যদি অনেক বেশি সংখ্যক প্রশ্ন উপস্থাপিত হয় তাহলে তিনি চাইওলে আলাদা আলাদাভাবে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিয়ে সরাসরি আরেকটি সংক্ষিপ্ত লেকচার আপলোড করে দিতে পারেন বিশেষ করে যাদের ক্ষেত্রে উত্তর টাইপ করাটা সময়-সাপেক্ষ বা ঝামেলা মনে হতে পারে।
এখন ফেসবুক গ্রুপ দুইভাবে খোলা যেতে পারে। একটি হতে পারে যে একটি কোর্সের জন্য দুইজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গ্রুপটিতে থাকবে। আরেকটি হতে পারে ব্যাচ ভিত্তিক সবগুলো কোর্সের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একটি প্রাইভেট গ্রুপে সংযুক্ত থাকবে।
দ্বিতীয়টি করলে সুবিধাটা হচ্ছে একজন শিক্ষকের ক্লাসের ধরণ বাকি অন্যান্য শিক্ষকরা দেখতে পাবেন। যদি কোন শিক্ষক মনে করেন তাহলে অন্যজনকে ফিডব্যাক দিতে পারবেন। এভাবে একে অপরকে ফিডব্যাক দিলে সবার ক্লাসের ধরণ ক্রমান্বয়ে ইম্প্রুভ হতে থাকবে এবং শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। কেননা একেকটি বিভাগ একেকটি পরিবারের মতো।
অনলাইন লার্নিং মেথডোলজি উপরে একটি কোর্স করার সময় দেখলাম যে একজন শিক্ষক নিজে থেকেই তার ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পেছনে একটি ক্যামেরা রেখে পুরো ক্লাস রেকর্ড করেন এবং বাসায় গিয়ে নিজে থেকেই ভিডিও দেখে সেই ক্লাসের মান রিভিউ করেন।
কারো কারো কাছে এটাও শুনেছি যে বিদেশের ইউনিভার্সিটিগুলোতে ক্লাসরুমে এক ধরনের ব্যবস্থাপনা রয়েছে। যেকোনো একজন শিক্ষকের ক্লাস চলাকালে অপর একজন শিক্ষক চা বা কফি হাতে নিয়ে তার ক্লাসে প্রবেশ করে চা বা কফি পান করতে করতে ঐ শিক্ষকের ক্লাস দেখতে পারেন।
ইন্টারনেট প্যাকেজের দামঃ
এখন যে প্রশ্নটি থাকতে পারে তা হচ্ছে ইন্টারনেটের ডাটা প্যাকেজের দাম। বর্তমান সময়ে সিম গুলোতে বিভিন্ন ধরনের অফার দেয়া হচ্ছে। তবে সামগ্রিকভাবে ৩০০-৪০০ টাকার মধ্যে মাসিক প্যাকেজ কিনলে ২০-৩০ জিবি ডাটা পাওয়া যায়। এতে করে সবগুলো ক্লাস ডাউনলোড করতে কোন রকম অসুবিধা থাকবে না। যাদের ডাটা প্যাকেজ কেনার কোনরকম সামর্থ্য নেই, বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের তালিকা প্রণয়ন করে বিভিন্ন ফান্ড থেকে সহায়তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সামগ্রিক দিক বিবেচনায় রেকর্ডেড ক্লাস অপশনটি বর্তমান সময়ে আমরা গ্রহণ করতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে আমি দেখেছি প্রায় সকলে অনলাইনে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে উপস্থিত নিয়মিত উপস্থিত থাকে। আমি আশা করি যে তারা এটাকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করবে এবং অবসর সময়গুলোকে প্রডাক্টিভ কাজে ব্যবহার করতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমাদের সেশনজটে পড়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে আসবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়