একই করোনাভাইরাসে কিছু আক্রান্তের প্রাণহানি ও অন্য রোগীদের মৃদু লক্ষণের কারণ

  © টিডিসি ফটো

কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী নভেল করোনাভাইরাস (SARS-CoV-2) কিছু মানুষকে মারাত্মকভাবে সংক্রমিত করার ফলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ভেন্টিলেশন প্রয়োজন হচ্ছে। পক্ষান্তরে অন্যদের ক্ষেত্রে মৃদু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কোভিড-১৯ রোগীর জন্য ঝুঁকির প্রধান ফ্যাক্টরগুলো হলো— ১. বয়স ২. ডায়াবেটিস ৩. হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ ৪. ধুমপান ৫. ফুসফুসে সমস্যা।

⇒ ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ বছর বা তদুর্ধ. বয়সের কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুহার তুলনামূলক অনেক বেশি। এই ধরণের বয়স্ক রোগীরা মারাত্মক সংক্রমণের ফলে হাসপাতালে বা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) মারা যাচ্ছে। বয়স্ক রোগীদের ক্রনিক স্বাস্থ্য সমস্যা (যেমন: ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি) থাকার কারণে কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণ ও জটিলতা বাড়িয়ে দিতে পারে।

মার্চ ৩০, ২০২০ তারিখের "দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস" জার্নালের গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, কোভিড-১৯ রোগে ৮০ বছর বা তদুর্ধ. বয়সের রোগীদের গড় মৃত্যুহার ১৩.৪%; ৬০ বছর বা তদুর্ধ. বয়সের রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার ৪.৫%; এবং ৬০ বছর বয়সের কম রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার ১.৪%। সিডিসি প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ক্রনিক অসুস্থতা (যেমন: ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি) কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণসমূহ বৃদ্ধি করতে পারে।

মার্চ ৩০, ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক নিউজ ওয়েবসাইট "স্ট্যাট" প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ রোগের মৃত্যুর জন্য, ক্রনিক অসুস্থতা একমাত্র কারণ নয়; বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়াও দায়ী। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হয়ে যায় এবং ভাইরাসের সাথে লড়াইয়ের ক্ষমতা কমে যায়; ফলে তীব্র সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যদি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাথমিক অবস্থায় নভেল করোনাভাইরাসকে (SARS-CoV-2) প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, তখন ভাইরাস বলিষ্ঠভাবে ফুসফুসকে আক্রমণ করতে শ্বাসনালী দিয়ে নিম্নমুখে অগ্রসর হয় এবং ফুসফুসে ভাইরাস মারাত্মক রুপ ধারণ করে (সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স")।

⇒ ডায়াবেটিস মেলিটাস হচ্ছে, একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যেখানে রক্তে ক্ষতিকর গ্লুকোজ (শর্করা)-এর পরিমাণ খুব বেশি থাকে, কারণ শরীর এটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারে না। মনে করা হচ্ছে, ডায়াবেটিসের সাথে খুব মারাত্মক কোভিড-১৯ ঝুঁকির সম্পর্ক আছে (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "লাইভ সায়েন্স")। ডায়াবেটিস মেলিটাস একটি বিপাকীয় রোগ, যা দুইটি ভাগে (টাইপ-১ ডায়াবেটিস ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস) বিভক্ত। বিশ্বে প্রায় ৯০% ডায়াবেটিস রোগী হচ্ছে, টাইপ-২ এবং বাকি দশ শতাংশ টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত (তথ্যসূত্রঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।

টাইপ-১ ডায়াবেটিস দেখা দেয় যখন দেহের অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন-উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়, শরীর কোন ইনসুলিন উৎপাদন করতে অক্ষম হয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিস দেখা দিলেও শরীর তখনও কিছুটা ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে, কিন্তু তার পরিমাণ যথেষ্ট হয় না, অথবা তখন উৎপন্ন হওয়া ইনসুলিন যথাযথভাবে কাজ করে না (যা "ইনসুলিন প্রতিরোধ" নামে পরিচিত)। এপ্রিল ২৩, ২০২০ তারিখের "জার্নাল অফ ইনফেশন" এর অনলাইনে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, ১৩টি স্ট্যাডিজের রিভিউয়ে বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন, ডায়াবেটিস রোগ থাকার কারণে কোভিড-১৯ রোগের ক্রিটিকাল (জটিল) অবস্থা বা মৃত্যুর সম্ভাবনা, কোন ক্রনিক স্বাস্থ্য সমস্যা (যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসে সমস্যা ইত্যাদি) না থাকা কোভিড-১৯ রোগীর চেয়ে প্রায় ৩.৭ (তিন দশমিক সাত) গুণ বেশি ছিল।

এপ্রিল ৯, ২০২০ তারিখের "জার্নাল অফ ডায়াবেটিস রিসার্চ এন্ড ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস" এর অনলাইন প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে বিজ্ঞানীরা রিপোর্ট করেছেন, বয়স্কদের যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের ফ্লুর কারণে সচরাচর নিউমোনিয়া হয় এবং মারাত্মক রূপ ধারণ করে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ রোগটি মারাত্মক হওয়ার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা কিছু সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। কোভিড-১৯ রোগীর, ফুসফুসের ক্রনিক প্রদাহ, রক্তজমাট ক্রিয়া বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ সাড়ায় বিশৃঙ্খলা, এবং নভেল করোনাভাইরাস SARS-CoV-2 দ্বারা সরাসরি অগ্ন্যাশয়ের (ইনসুলিন-উৎপাদনকারী কোষগুলির) ক্ষতিসাধন, এগুলো সম্ভাব্য কারণগুলোর অন্তর্ভূক্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্রমবৃদ্ধি দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস, কোভিড-১৯ রোগের সাথে লড়াইয়ে জড়িত দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ব্যবস্থাগুলোর ক্ষতি সাধন করে (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "লাইভ সায়েন্স")। ফলে, কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী করোনাভাইরাস SARS-CoV-2 দ্বারা আক্রান্তের ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের আরোগ্য লাভ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

"জার্নাল অফ ডায়াবেটিস রিসার্চ" এ প্রকাশিত রিভিউ আর্টিকেলে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন, ডায়াবেটিস ও স্থুলতার কারণে দেহের সংক্রমণের লড়াইয়ে সহায়তাকারী "শ্বেত রক্ত কণিকা" এবং "বি" কোষ উভয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

ফুসফুস করোনাভাইরাস দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সময় রোগ প্রতিরোধে সহায়তার জন্য দেহে "কেমোকাইন" (Chemokine) নামক "সিগন্যালিক প্রোটিন" (এক ধরণের "সাইটোকাইন" প্রোটিন) অধিক পরিমাণে উৎপন্ন হয় (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স")। যখন অনেক "কেমোকাইন" (সাইটোকাইন) উৎপাদিত হয়, তা দেহের অরগ্যানগুলোর ক্ষতি (damage) করে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "লাইভ সায়েন্স")।

⇒ আমেরিক্যান হার্ট এসোসিয়েশন প্রদত্ত তথ্য মতে, যাদের হৃদসংবহনতন্ত্রে সমস্যা আছে অর্থাৎ হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাঁরা সচরাচর হৃদসংবহনতন্ত্রে সমস্যাহীন মানুষের চেয়ে কোভিড-১৯ রোগে অধিকতর মন্দ শারীরিক জটিলতায় ভুগে। ভাইরাস সুস্থ মানুষেরও হৃদপিন্ডের ক্ষতি করে। যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত একজন ৫৭ বছর বয়সের মহিলার হৃদপিণ্ডের মাংসপেশী ড্যামেজ হয়ে মৃত্যুর রিপোর্ট পাওয়া গেছে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "লাইভ সায়েন্স")। চীনের উহানে কোভিড-১৯ রোগীদের এক স্ট্যাডিতে, পাঁচজন রোগীর মধ্যে গড়ে একজনের বেশী রোগীর হৃদপিণ্ডের মাংসপেশী ড্যামেজ ঘটেছে।

কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV-2 ফুসফুসে আক্রমণ করে দেহে অক্সিজেন ঘাটতি সৃষ্টি করে। সেকারণে হৃদপিন্ড অধিক চাপ বহনের মাধ্যমে পাম্প করে দেহে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত সরবররাহ করে। অধিকিন্তু, ভাইরাস, হৃদপিন্ডের এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম-২ রিসেপটরে সংযুক্ত হয়ে সরাসরি হৃদপিন্ডকে আক্রমণ করে।

কেমোকাইন মানবদেহে রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন ছাড়াও, ক্ষতের সময় হেমোস্ট্যাসিস (Hemostasis) পর্যায়ে রক্ত জমাটে (ব্লাড ক্লট) গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে (তথ্যসূত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ মোলিকুলার সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ)। কোভিড-১৯ রোগীর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত "কেমোকাইন" (সাইটোকাইন) প্রাণঘাতী কারণ তা ফুসফুসের মূল ধমনী (রক্তনালী) ছাড়াও হৃদপিন্ডে এই রক্ত জমাটগুলো (ব্লাডক্লটগুলো) ঘটাচ্ছে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স" ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ সাইট এবিসি সেভেন)।

⇒ ধুমপান সরাসরি ফুসফুসের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্থ করে থাকে। সেকারণে ধুমপায়ীরা কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত নিউমোনিয়া (ফুসফুসের প্রদাহ) ডেভলপ করে এবং তীব্র শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হয়। অধিকিন্তু ধুমপান অনেক বছর ধরে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নষ্ট করে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "লাইভ সায়েন্স")। অতি সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভাইরাস -- ফুসফুসের যে রিসেপটরে (এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম-২) সংযুক্ত হয়ে ফুসফুস আক্রমণ করে; ধূমপানের ফলে ফুসফুসে এই রিসেপটরের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় এবং ভাইরাসের আক্রমণ আরও সহজতর হয়।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ