জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সবার আগে কেন?
- ফয়সাল আকবর
- প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০১৯, ০৯:৪২ PM , আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৯, ০৯:৫৭ AM
২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি নিয়ে তুঘলকি কান্ড করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। মূল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে এবং কোন প্রকার ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তির তারিখ ঘোষণা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
গতকাল ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়টির নেওয়া সিদ্ধান্ত মতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথমবর্ষে ভর্তির আবেদন ১ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হবে। প্রার্থীদের অনলাইন আবেদন ফরম ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কলেজে জমা দিতে হবে। এবং ১ অক্টোবর থেকে শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হবে।
অথচ ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ১৩-২৮ সেপ্টেম্বর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ২৭-৩১ অক্টোবর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ৩০ সেপ্টেম্বর-১০ অক্টোবর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ১৪-২১ সেপ্টেম্বর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ২০-২২ অক্টোবর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ৪-৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংসহ অনেক পাবলিক বিশ্বিবদ্যালয় এখনো ভর্তি পরীক্ষার তারিখও নির্ধারণ করেনি। ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার পর একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোতে ভর্তি কার্যক্রম শেষ হতে নভেম্বর মাস পর্যন্ত যাবে। সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই আগামী ১ অক্টোবর থেকে প্রথম বর্ষের ক্লাশ শুরু করবে!
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন তুঘলকি সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হবে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। শুধুমাত্র এই সিদ্ধান্তের কারণে এই বছর অন্ততঃ অর্ধ লক্ষাধিকের বেশি শিক্ষার্থীকে প্রথমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে পরে আবার সেই ভর্তি বাতিল করতে হবে! ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এত সুন্দর আয়োজন!বাহ!!
এই কথা অনস্বীকার্য যে, দেশের অধিকাংশ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর স্বপ্ন থাকে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিক্যালে কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার। আসন স্বল্পতার কারণে সুযোগ না পেয়ে বেশিরভাগই তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে। সেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা এবং ভর্তি কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি এবং ক্লাশ শুরু করে ফেলা কতটুকু বিবেচনাপ্রসূত তা প্রশ্ন রাখে?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তকে অনেকেই টাকা কামানো অভিনব ‘পন্থা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। খোদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মাস্টার্সে দ্বৈত ভর্তি এবং তা বাতিল করার নামে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শত কোটি টাকার ব্যবসা করে প্রতিবছর। গত বছর থেকে নতুন করে যুক্ত হল- স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে সবার আগে ভর্তি এবং তা বাতিলের নামে ভর্তিচ্ছুদের পকেট খালি করা। অনেকের কাছে এই হিসাবটা ক্ষুদ্র মনে হতে পারে। আসলে এই পন্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় শত কোটি টাকা আয় করে নেয়। কিভাবে তা বুঝতে চান- ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম বর্ষে ভর্তি যোগ্য আসন আছে ৪৭ হাজার ৪০৭টি এবং মেডিকেল, মেরিন ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে আসন আছে প্রায় ১৩ হাজার। আর অন্যদিকে ২০১৯ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন শিক্ষার্থী।
সেই হিসেবে শিক্ষার্থীদের পছন্দের আসনগুলোতে ভর্তি হতে প্রতিজনকে লড়তে হবে অন্তত ১৬ জনের সাথে। তাই সবাই উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হতে না পারার শঙ্কা থেকে মুক্ত থাকতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে- এটাই স্বাভাবিক। বলা যায়, চলতি শিক্ষাবর্ষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, মেডিক্যালে এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হতে যাওয়া ৬০ হাজার শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই এবং ঢাবি অধিভূক্ত ৭ কলেজের অনেক শিক্ষার্থী প্রথমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। এসব শিক্ষার্থীদেরকে ভর্তি আবেদন বাবদ, ভর্তি ফি বাবদ এবং ভর্তি বাতিল বাবদ অন্ততঃ ১৫ হাজার টাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোতে দিতে হবে। একটু হিসাব করে দেখা যাবে- এই এক তুঘলকি কান্ডের মর্মে নিহিত আছে শত কোটি টাকার খেলা।
এছাড়া সদ্য এইচএসি পাস করা একটা ছেলে বা মেয়ের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেই ভর্তি বাতিল করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ভর্তি হওয়া কতটা বিড়ম্বনাদায়ক তা শুধু ভর্তিচ্ছুরাই বুঝে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বুঝবে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাল-চলন দেখলে মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়টির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে লাখে লাখে শিক্ষার্থী ভর্তি করা আর গ্র্যাজুয়েট সনদ দিয়ে উচ্চশিক্ষিত বেকার তৈরি করা। শিক্ষার্থীরা কি শিখছে বা না শিখছে সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আর শিক্ষার্থীদের বা ভর্তিচ্ছুদের লাভ-ক্ষতিও তাদের কাছে ধর্তব্য না।
এমতাবস্থায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি সুস্পষ্ট অযৌক্তিক কর্মকান্ড ছাড়া আর কিছু না। কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আগেই ভর্তি কার্যক্রম শেষ করার ফলে অনেক মেধাবী ভর্তি হওয়ার পর বিপাকে পড়বে এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যা শিক্ষার্থীদের সাথে সুস্পষ্ট প্রহসন এবং প্রবঞ্চনা।
তাই, অবিলম্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনা করে প্রথম বর্ষে ভর্তির তারিখ পিছিয়ে দিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-ভর্তিচ্ছুদের সোচ্চার হওয়া উচিত। এছাড়া উচ্চশিক্ষার স্বার্থে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোকে স্বায়ত্ত্বশাসিত করে পুরো প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন রুপে সাজানো উচিত সরকারের।
লেখক: ৩৫তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত এবং লেকচারার, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।