ভারতীয়দের নবীজি ঠিক কতটুকু জানতেন?

ম্যাপ
ম্যাপ  © সংগৃহীত

ভারতীয় খেলা: নবীজি (সা.) অনন্ত দু'টি খেলা নিষিদ্ধ করেছেন যা ইন্ডিয়ান অরিজিন ছিলো। এক. চৌপার/চৌসার (chausar game) যা বর্তমান লুডুর মতো; দুই. শতরঞ্জি (shatranj game) যা বর্তমান দাবার মতো। [দেখুন: কানযুল উম্মাল, খ. ৩ পৃ. ৩৩১]

ভারতীয় শব্দ: ফিলোলোজিস্টরা পবিত্র কুরআনে অন্তত তিনটি শব্দ খুঁজে পেয়েছেন যা ভারতীয় সংস্কৃত ভাষার অরিজিন; আর ভারতীয় বণিকগণ-ই তা আরব ভূমিতে বহন করে নিয়েছিলেন। আরবরা কুরআন নাযিলের পূর্বে তা রপ্ত ও আত্তিকরণ করে নিয়েছিলেন। এক. কাফুর [৭৬:৫] যা সুগন্ধি কর্পুর; দুই. যানজাবীল [৭৬:১৭] যার অর্থ আদা; তিন. মিসক [৮৩:২৬] যার অর্থ 'কস্তুরী' সুগন্ধি।

কখনো হরমুজ আর কখনো বাবেলমান্দেব হয়ে আরব উপকুলীয় বন্দরগুলোতে এবং তারীকুল কাওয়াফিল ধরে বাণিজ্য নগরীগুলোতে পৌঁছে যেত বণিকরা। এসব বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে কাফিলা পরিচালনা করেছেন স্বয়ং নবীজি (সা.)। সৌদির পূর্ব উপকূল আল-কাতীফ/আল-আহসা/তৎকালীন বাহরাইন থেকে হরমুজের উবুল্লা বন্দর আর কতই-বা দূর!

আরও পড়ুন : উই রিভোল্ড : রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান ও বিজয় দিবস

ভারতীয় জাঠ সম্প্রদায়: ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য হরিয়ানা ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে বাস করে জাঠ সম্প্রদায়ের সদস্যরা। জাঠরা দীর্ঘদেহী, এদের মুখমণ্ডল ক্ষুদ্র ও প্রশস্ত, নাক দীর্ঘ, ক্ষেত্র বিশেষে কিছুটা বাঁকা। এদের গায়ের রং বাদামি। চোখ গভীর কালো কখনো হালকা বাদামী, চুল কালো সরল ও কোকড়ানো। ঐতিহ্যগতভাবে জাঠরা কৃষি নির্ভর একটি সম্প্রদায়। যদিও সারা বিশ্বেই তাদের বিচরণ লক্ষণীয়। কৃষিই তাদের জীবিকার প্রধান উৎস। বংশানুক্রমে তারা মেষপালন করে আসছে। 

নবী মূসার (আ.) শারীরিক গঠন বর্ণনায় নবীজি (সা.) জাঠদের সাদৃশ্য টেনেছেন [মাজমাউল বাহর, খ. ২, পৃ. ৬২]। উম্মাহাতুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) অসুস্থ হলে একজন জাঠ সম্প্রদায়ভুক্ত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন বলে বর্ণিত রয়েছে [বুখারী, আদাবুল মুফরাদ, পৃ. ২৭]। 

গবেষকদের দাবি, নবীজির (সা.) সময় জাঠ সম্প্রদায়ের কেউ কেউ  আরবে বসতি স্থাপন করেছিলেন। উল্লেখ্য, বর্তমানে জাঠ সম্প্রদায়ে হিন্দু, মুসলিম এবং শিখ- এই তিন ধর্মের লোকই আছে।

ভারতের যুদ্ধ: হাদীসের  বিশুদ্ধ ছয়টি গ্রন্থের মাঝেই ইমাম নাসাঈর (র.) 'আস-সুনান' একটি। এতে একটি পরিচ্ছেদের শিরোনাম 'গাযওয়াতুল হিন্দ' তথা হিন্দুস্থানের যুদ্ধ। এই হাদীস নবীজির (সা.) ভারত সম্পর্কে পরিপুর্ণ অবহিত থাকার প্রমাণ।

আরও পড়ুন : লাইফ সাপোর্ট মানেই কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, এটা ভুল ধারণা! 

ভারতীয় পণ্য: নবীজির (সা.) চিকিৎসা উপাদানের একটি ছিলো ‘আল-উদ আল-হিন্দি’ (العود الهندي) যা সমকালীন আরবে ভারত থেকে সরবরাহ করা এক প্রকার সুগন্ধি কাঠ [বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং. ৫৭১৫]। সম্ভবত এ কাঠের নাম ‘আল-উলওয়া’ (الألوة) যা সুগন্ধী হওয়ায় জান্নাতের গৃহ নির্মাণে ব্যবহৃত হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে [বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং. ৩২৪৫]। 

নবীজিকে (সা.) বিদায় হজ্জের ইহরাম করার পূর্বে আয়েশা (রা.) যে জারীরাহ (ذريرة) নামক এক প্রকার খুশবু দিয়ে সুশোভিত করেছেন তা ছিলো ভারতীয় [মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১১৮৯]।

উসমান (রা.)-এর সময় মসজিদে নব্বীর ছাদ নির্মাণে ‘আল-সাজ’ [الساج] নামক যে বৃক্ষের কাঠ সংগ্রহ করা হয়েছিলো [বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং. ৪৪৬] তাও ছিলো ভারতীয় সেগুন কাঠ।

ভারতীয় চেহারা ও দৈহিক গঠন: বিখ্যাত সাহাবী খালিদ ইবন ওয়ালিদকে (রা.) বনূ হারেসের নিকট ইসলামের দাওয়াত নিয়ে প্রেরিত হন নবীজি (সা.) কর্তৃক। তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। নবীজি (সা.) একটি পত্র প্রেরণ করে তাদের কতিপয় লোককে নিয়ে খালিদকে (রা.) মদিনায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন : বিল্ডিং কোড অমান্য : ভূমিকম্পে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়াবে?

খালিদের সাথে হারেস গোত্রের আব্দুল হারেছ কাইস হোসাইন, ইয়াজিদ ইবন আব্দুল্লাহ আল-মাদান, ইয়াজিদ ইবনুল মাহজাল, আব্দুল্লাহ আ-যিয়াদী, শাদাদ ইবন আব্দুল্লাহ আল কানানীসহ কয়েকজন নবীজির (সা.) নিকট উপস্থিত হলেন। আগুন্তকদের মুখের দিকে তাকিয়ে নবীজি (সা.) বলেন, من هؤلاء القوم الذين كأنهم رجال الهند؟ এরা কোন গোত্রের লোক? যেনো ভারতীয়? [সিরাত ইবনে হিশাম, খ. ২, পৃ. ৫৯৩-৪; তাবারী, খ. ৩, পৃ. ১৫৬]

গবেষকদের দাবি, ভারতীয় বংশোদ্ভূত বনূ হারিস বাণিজ্যিক যোগাযোগের কারণে আরবে বসতি স্থাপন করেছিলো। ভারতীয় সাহাবী: ইমাম হাকিম (র.) তাঁর ‘মুস্তাদরাক’ গ্ৰন্থে আবু সাঈদ আল খুদরী (রা.) বর্ণিত একটি হাদীসে ‘মালিকুল হিন্দ’ তথা ‘ভারতীয় রাজা’ বলে একজনের কথা উল্লেখ করেছেন যিনি নবীজিকে (সা.) এমন এক বয়াম আচার হাদিয়া করেছেন যাতে আদার টুকরা ছিল। নবিজী (সা.) সেই টুকরাগুলো তাঁর সাহাবীদের ভাগ করে দিয়েছিলেন। আবূ সাঈদও (রা.) একটি টুকরা ভাগে পেয়েছিলেন’ [হাকিম, মুস্তাদরাক, ৭১৯০]। হাদীসটির সনদ দূর্বল।

মালাবারের পুঁথি সাহিত্যের সুত্রে তাঁর নাম রাজা চেরামান পেরুমল। মালাবারের বিস্তৃত অঞ্চলের তিনি রাজা ছিলেন। বলা হয়, নবীজি (সা.) তাঁর নাম রাখেন তাজউদ্দীন। বর্ণিত আছে, তিনি মক্কায় চন্দ্র দ্বি-খন্ডনের ঘটনা দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূল থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন কিংবা কোনো কাফিলার কাছে শুনেছিলেন। পরে মদীনায় গিয়ে তিনি ইসলাম গ্ৰহণ করেছিলেন। 

আরও পড়ুন : নতুন কুঁড়ি ২০২৫: বাংলাদেশী মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক দারিদ্র্যের নজির

বলা হয়ে থাকে, তিনি সেখানে প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ বছর অবস্থান করার পর নবীজির (সা.) নির্দেশে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ইতোমধ্যে তিনি প্রখ্যাত সাহাবী মালিক ইবন দীনারের বোন রাজিয়া’র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ফলে ফিরবার সময় তার সাথে মালিক ইবন দীনারসহ আরও ক’জন সাহাবী ছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে দক্ষিণপূর্ব আরবের এক বন্দরে (বর্তমান ওমানের সালালা শহর) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। আজও সালালায় তাঁর কবর রয়েছে। তবে সাহাবী মালিক ইবন দিনার (রা.) এবং তার বোন রাজিয়া (রা.) সহ অন্যান্য মুসলমানগণ  কেরালাতে আসেন এবং এখানেই তারা বসতি স্থাপন করেন। এখানে আগে থেকেই এক বিরাট আরব বণিকদের বসতি গড়ে উঠেছিল। সাহাবী মালিক ইবন দিনার সেখানে ভারতের প্রথম মসজিদ স্থাপন করেন। এই মহান সাহাবী ও তার বোন রাজিয়ার (রা.) কবর আজও এখানে বিদ্যমান রয়েছে।

সর্বোপরি এটা বলা যায়, নবীজি (সা.) ভারতীয়দের জানতেন। কবি কা'ব ইবন জুহাইর ইসলাম গ্ৰহণের পর নবীজির উপস্থিতিতে নবীজির (সা.) চারিত্রিক কোনো কোনো বৈশিষ্ট্যকে ভারতীয় তীক্ষ্ম ধারালো তরবারির সাথে উপমা দিয়েছেন। إن الرسول لنور يستضاء به مهند من سيوف الله مسلول

লেখক :  ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক

অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!