বিল্ডিং কোড অমান্য : ভূমিকম্পে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়াবে?
- মো. মোফাজ্জল হক
- প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:৩০ PM
ঢাকা নগরী দীর্ঘদিন ধরেই ভূমিকম্প অঞ্চলের ওপর অবস্থান করায় একটি শক্তিশালী কম্পন এখানে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন গবেষকরা। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন যে বঙ্গ-ভারতীয় প্লেট ও মিয়ানমার আর্ক-সিস্টেমের মধ্যকার ভূতাত্ত্বিক কারণে যেকোনো সময় বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। ভূমিকম্পের মাত্রার পাশাপাশি মাটির ধরন, জনঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং নিরাপত্তাহীন ভবন কাঠামো মিলেই ঢাকা শহরকে একটি ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে দাঁড় করিয়েছে। বিজ্ঞানী ও ভূকম্পবিদদের মতে, তুরস্ক বা নেপালের মতো উচ্চমাত্রার কম্পন ঢাকায় হলে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র হবে বহুগুণ বেশি। কারণ, শহরটি অতিরিক্ত নির্মাণ-চাপ, দুর্বল অবকাঠামো এবং সংকীর্ণ সড়ক ব্যবস্থায় পরিপূর্ণ।
ঢাকার ভূগর্ভস্থ মাটি অনেকাংশেই নরম অলুভিয়াল মাটি, যা কম্পনের সময় ‘শেকিং অ্যামপ্লিফিকেশন’ বাড়িয়ে তোলে। অর্থাৎ ভূমিকম্পের তীব্রতা বাস্তবে মাটির কারণে আরও বৃদ্ধি পায়, ফলে ভবনগুলো বেশি দুলে এবং সহজে ভেঙে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে ও বাংলাদেশ জিওলজিক্যাল সার্ভের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা ভূমিকম্প প্রতিরোধে সবচেয়ে অপ্রস্তুত শহরগুলোর একটি, যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ ভবন মাঝারি থেকে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সংকীর্ণ গলি, পর্যাপ্ত ওপেন স্পেসের অভাব এবং অপ্রশিক্ষিত নাগরিক সমাজ উদ্ধারকাজকে আরও কঠিন করে তুলবে।
ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) নামের যে নীতিমালা আছে, তা অনুসরণ করা আইনিভাবে বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। নির্মাণসামগ্রীতে মানহীনতা, যথাযথ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন ছাড়া নির্মাণ, কাঠামোগত বিশ্লেষণের অভাব, পরিকল্পনা অনুমোদনে দুর্নীতি এবং পরিদর্শন ব্যবস্থার ঘাটতি ভবনগুলোর প্রকৃত নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্থপতির নকশা অনুযায়ী নির্মাণ শুরু হলেও ঠিকাদার বা মালিক অর্থ সাশ্রয়ের জন্য গ্রেড কমিয়ে দেন, ইস্পাতের রডে কম ব্যাস ব্যবহার করেন, সিমেন্ট–বালির অনুপাত বিকৃত করেন কিংবা ভূমিকম্প-সহনশীল নকশায় থাকা শিয়ার ওয়াল, ফ্রেম বা বিম–কলামের শক্তিশালীকরণ বাদ দিয়ে দেন। ফলে ভবন বাহ্যিকভাবে আকর্ষণীয় হলেও ভেতর থেকে দুর্বল থাকে।
নীতিমালা অনুসরণ না করলে যে ঝুঁকিগুলো তৈরি হয়, তা শুধু একটি ভবনের সুরক্ষা নয়, বরং একটি পুরো এলাকাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। ভূমিকম্পে প্রথম যে বিপদ দেখা দেয় তা হলো ‘স্ট্রাকচারাল কলাপ্স’ যা ভবনের মূল কাঠামো ভেঙে পড়ে। ঢাকার অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত আবাসন এলাকায় কলাম–বিমের ব্যর্থতা হলে পুরো ভবন একসঙ্গে ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে, যাকে ‘প্যানকেক কলাপ্স’ বলা হয়। এই ধরনের ধস সবচেয়ে প্রাণঘাতী। পাশাপাশি শক্তিশালী ভবনের ওপর ভর করে দুর্বল ভবনের ধসে পড়া, গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, অগ্নিকাণ্ড এবং রাস্তায় ধ্বংসস্তূপে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে।
নীতিমালা না মানার আরেকটি বিপদ হলো ‘সয়েল লিকুইফ্যাকশন’ যা ভূমিকম্পের সময় নরম মাটির স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে তরল অবস্থায় পরিণত হয়। যে ভবনগুলো ঠিকমতো ফাউন্ডেশন বা গভীর পাইলিং ছাড়া নির্মিত হয়েছে, সেগুলো কাত হয়ে যাওয়া বা দেবে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। অনেক ভবনের ছাদ ও বারান্দায় অতিরিক্ত ওজনও ঝুঁকিকে বৃদ্ধি করে, যা আইনত সীমিত রাখা হলেও বাস্তবে বহুক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হয়।
এই বিপদের মধ্যে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হলো ঢাকার জনঘনত্ব। প্রতিটি ভবনের ধস বহু মানুষকে আটকে ফেলবে এবং উদ্ধারকাজ বাধাগ্রস্ত হবে সরু সড়ক ব্যবস্থা ও সুনির্দিষ্ট জরুরি পরিকল্পনার অভাবে। রোগী পরিবহনের ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, হাসপাতালগুলোরও নিজস্ব সক্ষমতা কমে যাবে কারণ অনেক হাসপাতাল ভবনও কাঠামোগতভাবে দুর্বল। পানীয়জল, যোগাযোগব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ দীর্ঘ সময় ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না।
এ বাস্তবতায় বিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন, নীতিমালা প্রয়োগই হলো ভূমিকম্প ক্ষতি কমানোর প্রধান উপায়। শক্তিশালী ভবন নির্মাণ, পুরোনো বিপজ্জনক ভবন পুনর্গঠন, নিয়মিত পরিদর্শন, নির্মাণসামগ্রীর গুণমান নিয়ন্ত্রণ, এবং নগর পরিকল্পনায় উন্মুক্ত স্থানের সংরক্ষণ আজ সময়ের দাবি। পাশাপাশি গণসচেতনতা, জরুরি উদ্ধার প্রশিক্ষণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বাড়ানো একটি নিরাপদ ঢাকা গঠনের জন্য অপরিহার্য।
ভূমিকম্পকে থামানো যাবে না, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। তাই বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের সতর্কবার্তা শোনার এখনই সময়। নীতিমালা অনুসরণ মানে শুধু আইন মানা নয়, এটি মানুষের জীবন রক্ষার সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হবে। না হয় ভূমিকম্পে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়াবে তা ভেবে দেখতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়