নতুন কুঁড়ি ২০২৫: বাংলাদেশী মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক দারিদ্র্যের নজির

নাজমুল হুদা আজাদ
নাজমুল হুদা আজাদ   © টিডিসি ফটো

১৯৭৬ সালে শিশু-কিশোরদের প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা হিসেবে 'নতুন কুঁড়ি' বাংলাদেশ টেলিভিশনে যাত্রা শুরু করে। উপমহাদেশের প্রথম রিয়েলিটি শো প্রতিভা অন্বেষণের এই সিগনেচার প্রোগ্রামটি শুরু থেকেই নতুন প্রজন্মসহ সকল শ্রেণীর দর্শকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি প্রোগ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সম্প্রতি 'নতুন কুঁড়ি ২০২৫' এর চূড়ান্ত পর্ব ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো।

ক ও খ শাখায় মোট বারোটি বিভাগে এ আয়োজনে প্রতিযোগীরা আঞ্চলিক ও বিভাগীয় পর্যায় শেষে চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণ করে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, চূড়ান্ত পর্বে হামদ- নাত, কৌতুক, গল্পবলা, আবৃত্তি ও অভিনয় ছাড়া বাকি যে বিভাগ সমূহ- লোকসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক গান, দেশাত্মবোধক গান, উচ্চাঙ্গনৃত্য, সাধারণ নৃত্য- প্রতিটি বিভাগে মুসলিম সম্প্রদায়ের শিশুদের অংশগ্রহণ ও সাফল্যের হার দুঃখজনকভাবে অত্যন্ত হতাশাজনক। বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় যে চর্চা ও সক্রিয় অংশগ্রহণের নিরিখে দিন দিন শিল্প- সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে যাচ্ছে এটা তার সাম্প্রতিক প্রতিচ্ছবি। তবে চর্চায় ও অংশগ্রহণে পিছিয়ে থাকলেও শিল্প- সংস্কৃতির কনজিউমার হিসেবে তারা এগিয়ে আছে এবং প্রশ্নটা এখানেই।

প্রশ্ন হলো নাচ ও গানের বিভিন্ন ধারা- উপধারা যদি ধর্ম বিবর্জিত ইস্যু হিসেবে আমি চর্চাই না করি; তবে এসবের সবচেয়ে বড় ভোক্তা হিসেবে আমার ভূমিকাটাকে স্ববিরোধের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত বলে কখন জ্ঞান করতে শিখবো? 

আবুল মনসুর আহমদ তাঁর 'বাংলাদেশের কালচার' গ্রন্থে মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গীত নিয়ে যথেষ্ট লিখেছেন। আট শতক হতে আঠারো শতক পর্যন্ত টানা হাজার বছর আরব, পারস্য ও ভারতের মুসলমানরা তদানীন্তন সভ্য জগতে সঙ্গীতশিল্পের নেতা, সঙ্গীত শাস্ত্রের শিক্ষক ও সঙ্গীত বিজ্ঞানের আবিষ্কর্তা ছিলেন। উপমহাদেশের সংগীতের যতো রাগ তার প্রায় আমির খসরু রচিত। নজরুল, আলাউদ্দিন, আব্বাসউদ্দিনের মতো বিদগ্ধ সংগীতজ্ঞতো আছেনই। মুসলমান মনীষীদের অনেকেই সঙ্গীত, সুর, তাল, রাগ- রাগিনী, বাধ্যযন্ত্র সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন যা এখনো সঙ্গীত শাস্ত্রের অমূল্য সম্পদ। পাঠান- মোগল আমলেও মুসলমানদের আনন্দ- বেদনায়, উৎসব- উদযাপনে নাচ- গানের ভালোই উপস্থিতি লক্ষণীয়। আকবর- আওরংজেবের নাচ- গানের সমঝদারিত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা আমাদের অজানা নয়। ইসলামের সূফি- সাধকদেরও মধ্যেও খাজা মইনুদ্দিন চিশতী নিজামুদ্দিন আউলিয়া প্রমুখ সূফী- সাধকগণও উস্তাদ, সুর শিল্পী ও সাধক গায়ক ছিলেন।

বাংলাদেশের আমরা যারা স্বাধীন সুলতানী আমল নিয়ে বড়াই করি; খেয়াল করলে দেখবেন তাদের শুধু সুলতানদের রাজনৈতিক শক্তিটাই চোখে পড়ে। স্বাধীন সুলতানদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে পৃষ্ঠপোষকতা ও নিজেদের মধ্যে উৎসাহ- উদযাপনের দিকটিকে তারা আলাপেই রাখতে চায় না। এই আমলেরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুঁথিতে আমরা ঘটনা বর্ণনার মধ্যে বিবরণের সাথে সংগতিপূর্ণ গানের উল্লেখ পাই। অনেক সময় সুর ও তালেরও উল্লেখ আছে। 

নতুন কুঁড়িতে মুসলিম সন্তানদের অংশগ্রহন ও সাফল্যের হার এতো দরিদ্র দেখে আমদের হাহুতাশের শেষ নাই। এটা ভেবে হাহুতাশ করি না যে, যে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মানুষ শষ্য বুনতে, তুলতে, নদী- সাগরে মাছ আহরণে, উঠানি বৈঠকে, মজমা- মজলিসে, অন্তহীন রাস্তার মানুষদের দৈনন্দিন চলাফেরায়, মাঠে, ঘাটে, বাজারে, এমনকি বিয়ে- শাদিতে, মৃত ব্যক্তির শোকে- বিলাপে সুর আর গানের যে ভরপুর আমেজ, উৎসাহ- উদযাপন; তার সবকিছুকে আমরা মোটামুটি অচ্ছুৎ বানিয়ে রাখার তৎপরতায় গভীরভাবে তৎপর গত কয়েক শতাব্দী ধরে। যার ফল এখন আমরা হাতেনাতে পাচ্ছি।

এক্ষেত্রে গত কয়েক দশক ধরে নগর থেকে তৃণমূলে ওয়াজ- মাহফিলের যে তীব্র বর্ধিত রুপ- তার একটা ভালোই প্রভাব বিদ্যমান। শুধু প্রভাব নয়; অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওয়াজ মাহফিলে কিছু কিছু বক্তাদের শিল্প, সাহিত্য- সংস্কৃতির প্রতি বিরূপ ও ধর্মীয় দ্বান্দ্বিক অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্যণীয় হারে বেড়েছে। আমরা কেন জানি ভাবতে ভুলে গেছি আমাদের শিশু- কিশোর ও তরুণদের নির্মল ও স্বতঃস্ফূর্ত, ঐতিহ্যগত ও নন্দনিক বিনোদন মাধ্যমের কথা। আমরা যতই এসব বিনোদন মাধ্যম এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি না কেন মনে রাখতে হবে আমরা এখন একটি বিশ্ব গ্রামে বাস করি। জীবনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে অনেক বৈশ্বিক শিল্প- সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গই অনিবার্যভাবে আমাদের ঘিরে রেখেছে। আপনি চাইলেও এখান থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখা সম্ভব নয়। ফলে দেশীয় শিল্প, সাহিত্য- সংস্কৃতি চর্চায় অবহেলা জনিত যে ভ্যাকুয়াম তৈরি হতে যাচ্ছে; তা অনিবার্যভাবে বৈশ্বিক নানা অনুসঙ্গ দ্বারা পূরণ হবে। এতে করে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য লালিত যে সমস্ত যুগ যুগের পুরনো শিল্প, সাহিত্য, সাস্কৃতিক মাধ্যম তা বিলুপ্তির আশংকা বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের সিলেক্টিভ শিল্প- সংস্কৃতির প্রতি ক্রমবর্ধমান যে অচ্ছুত মানসিকতা তার নিরসনে আমাদের বিদ্যৎ সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যারা রয়েছে সবারই নিরীক্ষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উদ্যোগী হওয়া সময়ের দাবি। নচেৎ দেশীয় শিল্প- সংস্কৃতি বিমুখ একটি উন্নাসিক প্রজন্ম পেতে আমাদের অপেক্ষা বেশি দূরে নয়।

মতামত লেখকের নিজস্ব

লেখক: নাজমুল হুদা আজাদ 
প্রভাষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।


সর্বশেষ সংবাদ