জামায়াত কি সত্যিই বিকল্প হয়ে উঠছে?
- মো. মোস্তফা বালা
- প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১০:২৩ AM
কয়েক দশক ধরে, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নামটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্নবোধক হয়ে টিকে আছে। এটি একটি বোঝা বা আপদ না সবেধন নীলমনি তা বুঝতে গেলে আসে অসংখ্য ব্যাখ্যা, যার কূলকিনারা নেই। জামায়াত একটি আদর্শবাদী এবং সুসংগঠিত ক্লাব বা ফোরাম হিসাবে ভাবতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এর সাথে রাজনীতি যুক্ত হওয়া, কালের মধ্য-ডান অবস্থান, সবক্ষেত্রে পরিমিত বোধও আমাদেরকে পুরোপুরি আশ্বস্ত করতে পারছে না তাদের কলঙ্কিত(?) ঐতিহ্যের জন্য।
কিন্তু রাজনীতি তো স্ট্যাটিক(স্থির) না। নানাবিধ জরিপ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলোতে নির্বাচনে জামায়াতের এনেক্স সংগঠনগুলোর ফলাফল সবাইকে অন্য বার্তা দিচ্ছে। গতানুগতিক অবয়ব ভেঙে জামায়াত অন্তৰভক্তিমূলক আধুনিক এক চিন্তাধারাকে শানিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। দলীয় লোগো পরিবর্তন, নারী কর্মীদের প্রকাশ্যে আনা, এনেক্সগুলোর ইতিবাচক কর্মকাণ্ড, সাধারণ লোকালয়ে অপেক্ষাকৃত ক্লিন ইমেজে তাদেরকে একটি নতুন ভঙ্গিমায় দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি জামায়াত আসলেই বদলে যাচ্ছে? নাকি এটি একটি সাময়িক ক্যামোফ্লাজ (ছদ্মবেশ)! জরিপগুলো আরো দেখিয়েছে তরুণেরা (জেন্-জি) ডানে ঝোঁকা এই দলটার প্রতি অধিক আগ্রহ দেখাচ্ছে ।
আকর্ষণের এই বিশেষ কারণ যতটা না জামায়াতের ধর্মতত্ত্ব বা অনমনীয় মতাদর্শ, আপাত শৃঙ্খল বা মিতভ্যাস অথবা নারীদের প্রতি কোমল অ্যাপ্রোচ তারচেয়ে বরং বেশি এটার বিকল্প কোনো ব্যবস্থার অনুপস্থিতি। তারা জামায়াতকে এমন একটি দল মনে করছে যা সুশৃঙ্খল, সংগঠিত এবং যা অন্যান্য নেতৃস্থানীয় দল গুলোর বিষাক্ত অলিগোপলিতে (নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা পরিবার) আবদ্ধ নয়। বর্তমানে দুর্নীতি, ক্ষেত্রবিশেষে চাঁদাবাজি এবং সুস্থ গণতান্ত্রিক অচলাবস্থায় বিরক্ত একটি প্রজন্মের কাছে জামায়াত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন: মির্জা ফখরুলকে জামায়াতের নায়েবে আমিরের ফোন
শরীয়া আইন নিয়ে জামায়াতের অবস্থান ব্যাখ্যার জন্য প্রশ্ন করলে তারা বেশ কৌশলী জবাব দেয়। কিছু কমন প্রশ্ন তাদের করা হয় যেমন -সব নারীদের বোরখা পড়তে বাধ্য করা হবে কিনা? অমুসলিমদের জিজিয়া কর দিতে হবে কিনা, চলচ্চিত্রের কী হবে? এক কথায় জামায়াতের শরীয়া 'মডেল' টা কেমন হবে? জামায়াতের প্রাজ্ঞ জবাবগুলোতে থাকে- শরিয়তের শতভাগ প্রয়োগ বিশ্বের কোথাও নেই। অতএব নির্দিষ্ট কোনো একক মডেলে জামায়াত বিশ্বাসী না। তবে জামায়াতের নিজস্ব মডেল কী তাও তারা পরিষ্কার করছে না। তাদের এই জটিল সমীকরণটা বুঝার আগে দেখি 'মডেল' উপস্থাপন জরুরি কেন। যে কোনো মডেলটা হচ্ছে মানুষ কে তার আকাঙ্ক্ষার একটি সহজ রূপরেখা দেয়, যেমন তার চাওয়া, নান্দনিক আবেদন, চাহিদার পরিধি এবং যোগান ও প্রাপ্তির গুছানো নির্দেশনা ইত্যাদি ।
যেমন কিছু মডেল আছে, শিক্ষার ক্ষেত্রে -আচরণবাদ (বেহেভিওরিজম), গঠনবাদ (কন্সট্রাক্টিভিজম), অথবা কলবের অভিজ্ঞতা মূলক শিক্ষা তত্ত্ব (এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিং থিওরি)। সব ‘লার্নিং থিওরি’ বা মডেল সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জামায়াত কেন জানি কলবের চার স্তর বিশিষ্ট এক্সপেরিমেন্টাল এই মডেলটাকেই উপলক্ষ্য করে আগাচ্ছে। তারা বলছে শরিয়ার সমগ্র উপসর্গ একসাথে ছাপিয়ে নয় বরং এটা বিন্যস্ত আকারে থাকবে। এর প্রতিফলন এবং ধারণা পর্যায়ক্রমে সমাজ মেনে নিলেই তা প্রয়োগ করা হবে কোনো ভৌগোলিক সীমারেখার জনপদের আকাঙ্ক্ষার আদলে। যেমন তারা যোগ করতে চায় ইসলামের নবী (স.)এর মদিনার আমলিক জীবনের প্রায়োগিক ধারাবাহিকতার পদ্ধতি। তারা আরো বলতে চায় যেমন শরীয়তে পুরুষের চার বিয়ের ক্ষেত্রে জামায়াত কি চাপ দিবে বা দিচ্ছে? না জামায়াতের কোনো প্রণিধানযোগ্য নেতা শরিয়তের বিধান মোতাবেক চারজন সহধর্মিণী নিয়েছে?
তুরস্ক, আফগানিস্তান, সৌদিআরব বা মিশরকে তাদের একক মডেল হিসাবে গ্রহণ করার সুযোগ নেই। তারা বলছে বাংলার ভৌগোলিক সীমানা, কৃষ্টিগত অভ্যাস, নৃতাত্ত্বিক উদ্ভব, সনাতন থিওলজি, ইসলামিক সুফিবাদ, মধ্যম যুগের (পনেরোশো থেকে দুই হাজার বছর আগে) শক, হুন, আর্য, শৈব, শক্ত, গানপত্য, বৌষ্ণব, বৌদ্ধ, জৈন ও পরে মঙ্গোলীয়দের ঢেউ এই জাতিকে যেভাবে সংক্রামিত করেছে একক কোনো মডেলর তাৎক্ষণিক আরোপ টেকসই হবে না।
তাদের এই বিশ্লেষণ উপলব্ধি থেকে নাকি কোনো মতলব তা হৃদয়ঙ্গমের দায়িত্ব কিন্তু উদারপন্থি প্রগতিশীল শিক্ষক, রাজনৈতিক বা চিন্তাবিদদের। জামায়াতের এই সর্বময় উপস্থিতি অগ্রাহ্য করা বা অপ্রাসঙ্গিক ভেবে উপেক্ষা করা বুমেরাং হতে পারে। তাদের ছাত্রদের জয় ইতোমধ্যেই তা প্রমাণ করেছে। তাদের এই ফলাফল একটি বিচ্ছিন্ন ক্যামপাসের গল্প বলে মনে হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যারা জানেন তারা স্বীকার করবেন ছাত্র রাজনীতি সর্বদা জাতীয় পর্যায়ের পরিবর্তনের জন্য পরীক্ষার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন হোক, আশির দশকের এরশাদবিরোধী আন্দোলন হোক, এমনকি পরবর্তী নির্বাচনী ঢেউ হোক। যখন তরুণ ভোটাররা একদিকে ঝুঁকে পড়ে তখন পলিটিক্যাল মোটিভ ( রাজনীতির ধারাপাত) প্রায়শই তা অনুসরণ করে।
অতি সম্প্রতি কিছু আলোচনা এবং আলামত (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সহ অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূত বা বিশেষ প্রতিনিধিদের জামাতের সাথে সাক্ষাৎ) আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করছে। একটি রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থি দল গণতন্ত্রের জন্য হুমকি কিনা? এটা পরম যত্নের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে কারণ জামায়াত দীর্ঘিদিনের নিপীড়িত দক্ষ খেলোয়াড়। এটা অনস্বীকার্য যে জামায়াত আর অতীতের ভূত নয়। বর্তমানে তারা নিজেদের পুনরুজ্জীবিত করছে। এই উত্থান কেবল একটি একক দলের পুনরুজ্জীবনের ইঙ্গিতই দেয় না; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে গভীর পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটানোর পূর্ব ইঙ্গিত, অন্তত জরিপ তাই বলছে ।
তবে চ্যালেঞ্জ কেবল জামায়াতের পুনরুত্থান নয়, বরং বৃহত্তর রাজনৈতিক সম্প্রদায় কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া দেখায় সেটাও দেখতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি বহুত্ববাদী ব্যবস্থার মধ্যে সহাবস্থান করতে পারে এটা যেমন ঠিক কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণ না করলে, এটি বর্জনীয় চরমপন্থায় পড়ার ঝুঁকিও বহন করে। বাংলাদেশের প্রগতিশীল কণ্ঠস্বরের জন্য কাজটি স্পষ্ট আর সেটা হলো সংলাপের দরজা বন্ধ না করে উগ্রবাদের বিপদ (যদি থেকে থাকে) মোকাবিলা করা এবং ঐতিহাসিকভাবে দেশের শক্তি হিসেবে বিবেচিত মধ্যপন্থার সংস্কৃতি রক্ষা করা। জামায়াতের বর্তমান গতিপথ কি প্রকৃত বিবর্তন, নাকি অস্থায়ী ছদ্মবেশ তা এখনও অনিশ্চিত। তবে এটা নিশ্চিত যে এই পরিবর্তনকে উপেক্ষা করার অর্থ হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গঠনকারী ক্রমবর্ধমান গতিশীলতার ধারা গুলোর বড়ো একটিকে উপেক্ষা করা।