‘আই অ্যাম রিপন ভিডিও’ থেকে মিডিয়া ট্রায়াল, রিপনের সঙ্গে আমরা কি অন্যায় করছি না?
- রাজু নূরুল
- প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩০ PM , আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩৩ PM
গ্রামের একটা অশিক্ষিত ছেলে। অনেক ভাইবোনের সংসার। কাঠমিস্ত্রীর কাজ করে জীবন চালান। পান খেতে খেতে দাঁত কালো করে ফেলেছেন। জীবন তারে কিছু না দিলেও সরলতা দিয়েছে দুই হাত ভরে। আর তার ভেতর দিয়েছে ছন্দ।
ওসব ছন্দের কোন কূল-কিনারা নাই। উল্টাপাল্টা ছন্দ মেলান তিনি। সেই উল্টাপাল্টা ছন্দ শুনলে মেজাজ খারাপ হয় না। হাসি পায়। ওইসব ছন্দ তিনি ফেসবুকে ছাড়েন। আমরা ওসব দেখে হাসি। তার নাম আমরা জানি, ‘আই অ্যাম রিপন ভিডিও।’ তার ওইসব উল্টাপাল্টা কথা জনপ্রিয় হয়। ফলে কয়দিন পর তার অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে যায়।
এরপর বোধহয় শহুরে কারো চোখে পড়লেন তিনি। বুঝতে পারলেন তাকে একটু হেল্প করলে তো তিনি দাঁড়িয়ে যাবেন। একটা অ্যাকাউন্ট খুলে ওইটা ভেরিফাই করে দিলেন। ভাল ক্যামেরা দিয়ে কন্টেন্ট বানানো শুরু করলেন। কন্টেন্ট বানানোর জন্য দেশের নানা জায়গায় যাওয়া শুরু করলেন। দেশের বাইরেও গেলেন তিনি। মানে কিছু বিনিয়োগ করলেন। সেসব কন্টেন্ট আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল। ওইসব কন্টেন্টে তেমন কিছুই নাই। এরকম কন্টেন্ট আরও হাজার হাজার মানুষ বানায়। কিন্তু রিপনের সারল্য, তার সহজ হাসি লোকজন লুফে নেয়। লোকজন দেখে আনন্দ পায়, তিনি ওখান থেকে টাকা ইনকাম করেন। এটা এখন তার বিজনেস। এই বিজনেস করতে গিয়ে তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনের কতটুকু বলবেন, কতটুকু বলবেন না, সেটা তার ইচ্ছা।
একদিন এক টেলিভিশনের রিপোর্টার রিপনের এলাকায় গেলেন অন্য আরেকটা খবরের সন্ধানে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীর কাছে সেই লোকের ঠিকানা জানতে চাইলেন। সেই নারী যেচে নিজেকে ‘রিপন ভিডিও’র মা হিসেবে পরিচয় দিলেন (আমার ধারণা এইটা সত্য না)।
তারপর কথা বলতে বলতে তারা বাড়ির দিকে গেলেন। সেই সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন না, এই যে আপনি রিপনের মা, সারা দেশের মানুষ এখন আপনার ছেলেকে চিনে, দেশের প্রধান দৈনিক পত্রিকা আপনার ছেলেকে নিয়ে ফিচার করে, কেমন লাগে আপনার?
বরং সাংবাদিক জানতে চাইলেন, আপনার ছেলে টাকা পয়সা দেন আপনাদের? আপনারা থাকেন ভাঙা ঘরে আর তিনি এখন বিল্ডিং বানাচ্ছেন? তিনি কি বিয়ে করছেন? বিয়ে কি আপনারা করাইছিলেন? এসব প্রশ্ন শুনে মনে হয় রিপনের মার সাথে ওই সাংবাদিকের দেখা হওয়াটা কাকতালীয়?
এরপর সব কথাবার্তা আর দৃশ্য ধারণ শেষে তারা পাড়ার দোকানে বসে থাকা রিপনের কাছে গেল তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে! রিপন স্পষ্টভাবে বলছেন, আমি আমার পরিবার নিয়ে কথা বলব না। আমি কাউকে ইন্ট্যারভিউ দিই না। এরপর তিনি টেবিলে মুখ নামিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন! কিন্তু সাংবাদিক নাছোড়বান্দা। তিনি ক্যামেরা ধরে আছেন রিপনের মুখে। যেতে যেতে দূর থেকেও ক্যামেরা ধরে আছে রিপনের মুখে।
আমরা যারা রিপনের কন্টেন্ট দেখে হাসতাম, ৫ মিনিটের একটা রিপোর্ট দেখে হাসতে ভুলে গেলাম। কন্টেন্ট না, রিপনের হাসি না, সারল্য না, একটা টেলিভিশনের করা সম্পূর্ণ অনৈতিক একটা রিপোর্ট হয়ে গেছে আমাদের কাছে কাউকে বিচারের মানদন্ড!
এবার দেখি, রিপনের অপরাধসমূহ কি কি? হাতে টাকা আসার পর তিনি এখন আর বাপ-মাকে দেখেন না। বাপ-মা পুরনো বাড়িতে থাকেন, রিপন নতুন বিল্ডিং বানাচ্ছেন। তিনি বিবাহিত, কিন্তু কন্টেন্টে বলে বেড়ান তিনি অবিবাহিত। নিজের স্ত্রীকে ভাইয়ের স্ত্রী বলে পরিচয় গোপন করতে চান।
নাহ্। কেউ বাপ-মাকে না দেখলে তাকে গ্লোরিফাই করার লোক আমি না। আমি বাপ-মা অন্তপ্রাণ মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশের মত দেশে সন্তানের বাপ-মাকে দেখা কি খুবই আপেক্ষিক একটা বিষয় নয়? ৪/৫টা সন্তান নিয়ে যৌথ পরিবারের কোনো একজন সন্তান হুট করে টাকার মুখ দেখলে পরিবারের সবাই কি তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন না? নানাভাবে তার উপর যে চাপ সৃষ্টি করে, সেটা কি একপ্রকার জুলুম না? এক ছেলের করা ঋণ কি আরেক ছেলের উপর আমাদের বাবা-মারা চাপিয়ে দেন না? আপনি ১০০টা বাবা মাকে জিজ্ঞেস করেন যে, তার সন্তানেরা তাদেরকে দেখেন কিনা! ৯৯ জন বলবে, দেখে না! এই রিপোর্টে রিপনের পরিবারের কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নাই।
বাপ-মাকে দেখা বলতে কী বোঝায়, কতটুকু বোঝায় তার কোনো থ্রেশোল্ড নাই। কিন্তু রিপোর্টার আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেন যে, রিপন খারাপ! তিনি বাপ মাকে দেখেন না!
আমরা যারা গ্রামে বাবা-মাকে রেখে শহরে, দূর দূরান্তে থাকি, বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, সর্বশেষ কবে আপনার মার সাথে কথা বলেছেন আপনি? আপনার মায়ের হাত ধরে কবে রাস্তা পার হয়েছেন? আপনার মায়ের হাতের তালুর উল্টাদিকটায় যে ছোট ছোট কালশিটে দাগ পড়ে গেছে, বয়সের বলিরেখা যে তার মুখের ভাঁজে, সেটা কবে একটু খেয়াল করে দেখেছেন?
যে এটিএন বাংলা রিপনের মায়ের মুখের সামনে মাইক ধরে জিজ্ঞেস করে, ছেলে আপনাকে টাকা পয়সা দেয় না? সেই একই টেলিভিশন তার মালিক মাহফুজের মায়ের সামনে মাইক ধরে একই প্রশ্ন করতে পারবে? মাহফুজের মাকে চিনি আমরা? কোথায় থাকেন সেটা আমরা জানি? তাহলে রিপনের মাকে কেনো চিনতে হবে?
রিপন যে কন্টেন্ট থেকে টাকা আয় করা শুরু করেছেন সেটা বেশিদিন না তো! তিনি এখনো গ্রামে থাকেন, পাড়ার দোকানে বসে গুলতি মারেন! এখন সামর্থ থাকলে রিপন কেনো আলাদা বাড়ি করতে পারবেন না সেটা কি এই সাংবাদিককে কেউ জিজ্ঞেস করবেন না? তথ্য গোপন করলে যদি তার স্ত্রী-সন্তানের অসুবিধা না থাকে, যদি এতে তার কন্টেন্টের সুবিধা হয়, তাহলে তিনি সেটা গোপন করতে পারবেন না কেন?
আবারও বলি, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে, রিপন তার বাবা-মার প্রত্যাশা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে পারে নাই, এটা নি:সন্দেহে অন্যায়। কিন্তু সেটাকে যেভাবে একটা ন্যাশনাল মিডিয়ায় উপস্থাপন করে রিপনের মত একটা সাধারণ ছেলের উপরে ওঠার সিঁড়ি আটকে দেয়া হয়েছে, সেটা কি অন্যায্য নয়? এই রিপোর্ট কি সাংবাদিকতার কোনো মানদন্ডে পড়ে? মনে হয় না যে, ওখানে কোনো সাংবাদিকতা হয় নাই? যা হয়েছে সেটাকে বড়জোর ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ বলা যেতে পারে।
তাই সাংবাদিক চলে যাওয়ার পর রিপন যখন মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, কাঁদতে কাঁদতে যখন জিজ্ঞেস করে, ‘তোমারে কি দেই না আমি? আব্বারে দেই না? তোমরা এই কামডা কিতা করলা?’
এবার আপনি রিপনের মাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তো, উনি যদি জানতেন যে, মিডিয়ার সাথে কথা বলার কারণে তার ছেলের সর্বনাশ হয়ে যাবে, তাহলে এখন যা আছেন তারচেয়ে খারাপ থাকলেও ছেলের বিরুদ্ধে ইন্টারভিউ দিতেন কিনা? যে কোনো ইন্টারভিওতে অংশগ্রহণকারীকে সেটার প্রেক্ষাপট না জানিয়ে ইন্টারভিও করাটাইতো অন্যায্য, আনইথিক্যাল ! আর সেটা একটা ন্যাশনাল চ্যানেলে দেখানোটাতো রীতিমত অপরাধ!
রিপনকেও বলব, বাবা-মায়ের সাথে যদি কোনো দূরত্ব থাকে, সেটা মিটিয়ে ফেলুন। ভুল করলে সংশোধন করুন। বাপ-মা এমন যে, তারা সন্তানকে ক্ষমা করার জন্য উৎসুক হয়ে থাকে। আমি নিশ্চিত, মানুষও আপনাকে ফেলে দেবে না।
রাজু নূরুল: লেখক, অনুবাদক, গবেষক; যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com