মারিয়ার নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক, নেপথ্যে কি ভেনেজুয়েলার ৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের তেলসম্পদ?

রাজু নূরুল
রাজু নূরুল  © টিডিসি সম্পাদিত

১৯৯৯ সালে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন কট্টর বামপন্থী নেতা হুগো শাভেজ। তার সরকারের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নীতির মধ্যে ছিল দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক কর্মসূচি, তেল সম্পদের পুনর্বণ্টন এবং যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি। তখন বেশ কিছু ব্যবসায়ী নেতা, সমাজের অত্যন্ত উঁচু স্তরের কিছু এলিট এবং কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা শাভেজের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন; যার মূল অনুঘটক ছিল যুক্তরাষ্ট্র।

২০০২ সালের এপ্রিলের গোড়ার দিকে আচমকা এক ঘটনা ঘটে। কয়েকটা বিরোধী দল ও কিছু ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে বড় ধরনের বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ প্রেসিডেন্ট ভবনের দিকে গেলে সহিংস সংঘর্ষ হয়, কয়েকজন নিহত হন। সেনাবাহিনীর একটি অংশ শাভেজের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং তাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর পেদ্রো কারমোনা (Pedro Carmona) নামের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা নিজেকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি’ ঘোষণা করেন।

পরিস্থিতি বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগলেও শাভেজের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করেন। সেনাবাহিনীর অনেকগুলো ইউনিট ও সাধারণ মানুষ ‘শাভেজকে ফিরিয়ে দাও’ স্লোগান দিতে থাকে। সাধারণ মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের চাপে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়।

১৩ এপ্রিল ২০০২ সালে হুগো শাভেজ আবার রাষ্ট্রপতির পদে ফিরে আসেন। যুক্তরাষ্ট্র সেই অভ্যুত্থানকে ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন’ হিসেবে সমর্থন জানিয়েছিল। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশ অভ্যুত্থানকে অবৈধ ও গণতন্ত্রবিরোধী হিসেবে নিন্দা জানিয়েছিল।

বিরাট ধনকুবেরের মেয়ে এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী মারিয়া কারিনা মাচাদো তখন একটি এনজিও চালাতেন। মূলত ইলেকশন মনিটরিং করা ছিল তার এনজিওর কাজ। বিস্ময়করভাবে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট পেদ্রো যখন রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে যাচ্ছিলেন, সেখানে কারিনাকে দেখা যায়। পরে গণমাধ্যমে আসা এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কারিনা সেই অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল, জাতীয় সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট এবং সংবিধান অস্থায়ীভাবে বিলুপ্ত করা হবে। পাশাপাশি সব প্রতিষ্ঠান সংস্কার করা হবে।

হুগো শাভেজ যখন ক্ষমতা ফিরে পেলেন, তখন কারিনার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু কারিনা থেমে থাকেননি। গণতন্ত্রের নামে নিজ দেশের নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদ ও মজুদে থাকা ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল তেল আমেরিকার হাতে তুলে দিতে হেন কোনো উপায় নাই যা তিনি অবলম্বন করেননি।

২০১৮ সালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কাছে একটি চিঠি লেখেন এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী মারিয়া কারিনা মাচাদো। সেখানে বর্তমান নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে উৎখাত করতে ভেনেজুয়েলায় সামরিক হামলা চালানোর জন্য ইসরায়েলকে আহ্বান জানান তিনি। নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির সঙ্গে তার সখ্যতা নিয়ে নানা কথা চালু আছে। নোবেল পাওয়ার পর তার পুরনো একটি সাক্ষাৎকার ভাইরাল হয়েছে, ইসরায়েলি এক টিভিকে তিনি বেশ গর্ব করে বলছেন, ‘আমি জিতলে ইসরায়েলে আমাদের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করা হবে।’ গাজায় যে ইসরায়েলি বর্বরতা চলছে, কারিনা সব সময় তার পক্ষে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দিয়ে গেছেন।

এখানেই শেষ নয়, কয়েক দিন আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ভেনেজুয়েলাকে হুমকি দিলেন, কারিনা তাতে খুশি হয়ে সমর্থন জানিয়েছেন। সুযোগ পেলেই এই নেতা ভেনেজুয়েলার ওপর নতুন নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য আবেদন জানান। এতে করে তার দেশের লোকজনকে কী কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হবে, তাতে তার কিছু যায় আসে না। গত বছর তো নিজেই ভেনেজুয়েলায় আমেরিকার সাপোর্ট নিয়ে ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ গঠন করে ফেলেন, সেখানে নিজেই নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন আসতে পারে ভেনেজুয়েলা নিয়ে আমেরিকার এত আগ্রহ কেন? দেখুন, স্প্যানিশভাষী ২০টা লাতিন দেশের ১৮টাতেই বাম ও মধ্যপন্থীদের সরকার। আর্জেন্টিনা ও এল সালভাদর বাদে। এ নিয়ে পুঁজিবাদী দেশগুলোর গাত্রদাহের শেষ নেই। লাতিন আমেরিকায় গণতন্ত্রের নামে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ধরনের আধিপত্য জোরদার করতে চায়, এ পথে অন্যতম বাধা ভেনেজুয়েলা। এ ছাড়াও ভেনেজুয়েলা বিশ্বের সর্বাধিক প্রমাণিত তেলের মজুদের দেশ। দেশটির ভূগর্ভে মজুত রয়েছে প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল তেল, যা বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলার হিসেবে) মূল্য দাঁড়ায় ৩০ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অর্থাৎ, কেবল তেলসম্পদের হিসাবেই ভেনেজুয়েলার সম্পদের পরিমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জিডিপির চেয়েও বেশি।

আক্ষরিক অর্থেই ভাসছে ভেনেজুয়েলা। ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নজর বহুদিন থেকেই। কারিনা সেই রাজনীতিবিদ, যিনি বহুদিন ধরে তেল, পানি এবং অবকাঠামো খাতকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানির হাতে তিনি তুলে দিতে চান দেশের তেল সম্পদ। অনেকে বলছেন, এবার নোবেল শান্তি পুরস্কারের নেপথ্যে আছে ভেনেজুয়েলার বিপুল তেলসম্পদ দখল করার নতুন মিশন। এ মিশনে গোপনে কাজ করেন মারিয়া কারিনা, হয়তো তারই জন্য পেয়েছেন এই পুরস্কার। 

এখন পর্যন্ত বহুবার নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ভেনেজুয়েলাকে ‘স্বাধীন’ করতে বিদেশি সেনাদের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন মারিয়া কারিনা। মজার না ব্যাপারটা? শান্তিতে নোবেল বিজয়ীদের কাছে এই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটা খুব প্রিয়। তারা সুযোগ পেলেই নিজ দেশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন।

এবার সেই কারিনা পেয়েছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। তাও সেই শান্তি নাকি ভেনেজুয়েলার জনগণের জন্য! কারিনা পুরস্কার পাওয়ার পর মিচেল এলনার লিখেছেন, ‘মারিয়ার মতো ডানপন্থিরা যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতে, তখন শান্তির আসলে কোনো অর্থ হয় না।’

খুব স্বাভাবিকভাবেই কারিনা তার পুরস্কার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে উৎসর্গ করেছেন। ট্রাম্পকে ফোন করে জানিয়েছেন, ‘আমি এই পুরস্কারটি আপনার সম্মানে গ্রহণ করছি, কারণ প্রকৃতপক্ষে এটি আপনারই প্রাপ্য।’

ট্রাম্প খুশি হয়েছেন, সেটা বলাইবাহুল্য। সেই খুশির রেশ ভেনেজুয়েলার কষ্টভোগী জনগণকে কী দিয়ে চুকাতে হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়, যেমনটা চুকাচ্ছে আরও বহুবহু দেশ।

রাজু নূরুল: লেখক, অনুবাদক ও গবেষক 
যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com 


সর্বশেষ সংবাদ