ঋণনির্ভর উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং আমাদের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ শঙ্কা
- হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী
- প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৪ PM , আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৬ PM
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি বিদেশি সাহায্যনির্ভর দেশ থেকে এক সম্ভাবনাময় উদীয়মান অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। গত পাঁচ দশক ধরে তৈরি পোশাক শিল্প ও প্রবাসী আয় অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। প্রতিবছর বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশি উৎস থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে থাকে; এবং এখন পর্যন্ত সব ঋণের কিস্তি সফলভাবে পরিশোধ করেছে। এমনকি ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা কোভিড-১৯ মহামারির মতো বড় ধরনের আঘাত সত্ত্বেও বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঋণের সুদ পরিশোধের খরচ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে উঠেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেবল সুদ পরিশোধেই জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৮.৭ শতাংশ ব্যয় হয়েছে, যা সরকারের বার্ষিক রাজস্ব আয়ের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। এই সমস্যার প্রধান কারণ হলো আমাদের অত্যন্ত দুর্বল রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত, যা সাধারণত মাত্র ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে থাকে। বৈশ্বিক মানদণ্ডে এই রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক কম। ফলে প্রতিবছর আমরা যে সীমিত রাজস্ব আয় করি, তার একটি বড় অংশ অতীতের ঋণ শোধে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।
কোনো দেশের ঋণের মাত্রা বোঝাতে বহুল ব্যবহৃত সূচক হলো ঋণ-জিডিপি অনুপাত। বাংলাদেশের বর্তমান ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৪০ শতাংশের নিচে, যা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সীমা ৬০-৭০ শতাংশের অনেক কম। কিন্তু শুধু ঋণ-জিডিপি অনুপাত দিয়ে আমাদের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে না। এক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের জন্য সরকারের পর্যাপ্ত আয়ের সক্ষমতাও বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদ মনে হলেও, রাজস্ব আয়ের বিপরীতে সুদের বোঝা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে আমাদের আর্থিক ভারসাম্যকে দুর্বল করে তুলছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি প্রবৃদ্ধির উচ্চ গতি ধরে রাখতে ঋণ নিতে থাকব, নাকি দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমিয়ে আনব? এই মুহূর্তে ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিলে বাজেটের আকার আরও ছোট করতে হবে, কারণ রাতারাতি রাজস্ব আয় অনেক বেড়ে যাবে—এমনটা আশা করা যায় না। এর ফলে তাৎক্ষণিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমলেও তা ভবিষ্যৎ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। আমাদের অর্থনীতির মূল দুর্বলতা রাজস্ব আহরণের অক্ষমতায়। ১৭ কোটি মানুষের দেশে নিয়মিত আয়করদাতার সংখ্যা ৩০ লাখেরও কম। ভ্যাট আদায়ে রয়েছে নানা ছাড়, অনিয়ম আর অদক্ষতা। ব্যবসা ও ব্যক্তিপর্যায়ে কর ফাঁকি দেওয়ার মানসিকতা, বিপুল পরিমাণ নগদ লেনদেন এবং অপ্রকাশিত অর্থনীতির চর্চার ফলে রাজস্ব কর্মকর্তাদের কর আদায়ে নানান প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়। আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোও খুব সামান্য রাজস্ব সংগ্রহ করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ জিডিপির মাত্র ৮-৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ, যেখানে অধিকাংশ মধ্যম আয়ের দেশে তা ১৫-২০ শতাংশ।
এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ গ্রহণের ধরণের পরিবর্তন। আগে বিশ্বব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো সংস্থা থেকে অনেক কম সুদে রেয়াতি ঋণ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন অনেক বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তুলনামূলক ব্যয়বহুল দ্বিপাক্ষিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। বিগত সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার বিরাট অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশি ঋণের বোঝা আরও বেড়েছে। আগামী বছর এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কম খরচে বিদেশি ঋণ পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার যে ঋণ নেয় তার জন্যও অনেক উচ্চ হারে সুদ দিতে হয়।
প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পুরনো ঋণের সুদ পরিশোধের ফলে বাজেটের ভারসাম্য রক্ষায় যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, তা ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। অর্থ বিভাগ প্রকাশিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সমাপনী প্রতিবেদনে দেখা যায়, কেবল সুদ পরিশোধেই সরকারের ব্যয় হয়েছে ১,১৪,৫৯০ কোটি টাকা, যা স্বাস্থ্যখাত (২৩,৭২৬ কোটি) ও শিক্ষা খাতের (৮০,২৯০ কোটি) মোট ব্যয়ের চেয়েও বেশি। অর্থাৎ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে জরুরি খাতগুলোতে বিনিয়োগ সীমিত হচ্ছে পূর্বের ঋণের কিস্তি মেটাতে গিয়ে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। ভিয়েতনাম রাজস্ব আহরণ করে জিডিপির প্রায় ১৮ শতাংশ, এবং তাদের ঋণ-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৩৫ শতাংশ। কিন্তু তারা মোট রাজস্ব আয়ের মাত্র ৫-৬ শতাংশ খরচ করে সুদ পরিশোধে। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রায় অনুরূপ ঋণ-জিডিপি অনুপাত থাকা সত্ত্বেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের প্রায় ২৮ শতাংশ খরচ হয়েছে সুদ পরিশোধে। চলতি বাজেটে সুদ বাবদ ধরা হয়েছে ১,২২,০০০ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৫.৪ শতাংশ এবং সম্ভাব্য রাজস্ব আয়ের ২১.৬ শতাংশ। চলমান ধারাবাহিকতায় রাজস্ব আদায় লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে বছর শেষে এই মাত্রা আরও বাড়বে।
রাজস্ব সংস্কার বরাবরই রাজনৈতিকভাবে একটি কঠিন কাজ। সারা দুনিয়াতেই কর বাড়ানো কিংবা ভর্তুকি কমানো অত্যন্ত অজনপ্রিয় পদক্ষেপ, যা রাজনৈতিক সরকার সাধারণত এড়িয়ে যেতে চায়। ফলে তারা অনেক সময় রাজনৈতিক ঝুঁকি না নিয়ে সহজ সমাধান হিসেবে ঋণনির্ভর প্রকল্প গ্রহণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তিগুলো স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্যকেই বেশি প্রাধান্য দেয়, যা তাদের পরবর্তী নির্বাচন জিততে সহায়ক হতে পারে।
তবে ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ বৃদ্ধির এই সমস্যার সমাধান কিন্তু ঋণ নেওয়া একেবারে বন্ধ করা নয়। আকস্মিকভাবে জিডিপির আকার তথা উন্নয়ন ব্যয় অনেক কমে গেলে বেকারত্ব বৃদ্ধিসহ নানান সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হতে পারে। ন্যূনতম প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে অবকাঠামো ও সামাজিক খাতে বিনিয়োগ অপরিহার্য। তাই ঋণ গ্রহণের পরিমাণ কমানোর পাশাপাশি রাজস্ব সংস্কারে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। করজাল বাড়ানো, কর আদায়ে শৃঙ্খলা আনা, ডিজিটাল ট্যাক্স ব্যবস্থাপনা চালু করা জরুরি। ঋণ করে কোনো বড় প্রকল্প গ্রহণের আগে নিরপেক্ষভাবে এর দীর্ঘমেয়াদি উপযোগিতা বিশ্লেষণ করতে হবে। আবেগের বশবর্তী হয়ে কিংবা কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় আমরা যেন ভবিষ্যতে কোনো প্রকল্প গ্রহণ না করি, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হতে পারে ঋণ গ্রহণ এবং বাজেট ঘাটতির সীমা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন। ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে সরকার নির্ধারিত সীমার মধ্যে কাজ করছে কি না তা স্বাধীন কোনো কাউন্সিলের মাধ্যমে মনিটর করার বিধান রাখা যেতে পারে। এর ফলে সামগ্রিক অর্থনীতির উপর অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক প্রভাব কমবে এবং বাজেট ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আসবে। পাশাপাশি আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে যে, বড় বাজেট মানেই সবসময় সরকারের সফলতা নয়। টেকসই রাজস্ব সংস্কার ছাড়া ধারাবাহিক ঋণনির্ভরতা আমাদের অর্থনীতির সব অর্জনকেই ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
লেখক: হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী, গবেষক ও প্রাবন্ধিক, সিনিয়র সহকারী সচিব, বাংলাদেশ সরকার
মাস্টার অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পাবলিক পলিসি (ডিস্টিংশন), দি ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া
ই-মেইল: joki_53@yahoo.com