তারেক রহমানের উদার বক্তব্যে নতুন আলোচনা, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কোথায়?
- রাজু নূরুল
- প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৩৭ PM , আপডেট: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৪০ PM
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাসে বলেছেন, “বাংলাদেশটা সবার। সেখানে বিভিন্ন ধর্ম, গোত্র, জাতিগোষ্ঠী, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবাই থাকবে।” এখানে অবিশ্বাসী মানে নাস্তিক। বাংলাদেশে বোধহয় বহু বছর পরে এই প্রথম কেউ জনপরিসরে এই কথাটা বললেন যে, বাংলাদেশটা নাস্তিকেরও!
আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশে যারা প্রগতিশীল চিন্তা করেন, সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিরাট একটা অংশ; যাদেরকে এখন ‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’ ডেকে জুতাপেটা করা হয়, যারা ধর্মবিশ্বাসী না, যারা ধর্মচর্চা করেন না, কিংবা যারা ধর্মকে রাষ্ট্রের সাথে গুলিয়ে ফেলেন না, যারা কবি-সাহিত্যিক; তাদের যাওয়ার জায়গা ছিল একমাত্র আওয়ামী লীগ! ৭২-এর সংবিধানের প্রণয়নকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছিল।
বিএনপির মত বড় একটা রাজনৈতিক দল, কোটি কোটি ভোট যাদের, অথচ তারা এত বছরেও একটা কালচারাল উইং দাঁড় করাতে পারেনি। এটা তাদের বিরাট একটা আক্ষেপ! বিএনপিপন্থী কবি-সাহিত্যিকদেরকে আমি এই আক্ষেপটা প্রকাশ্যে করতে দেখি!
মনে রাখবেন, পৃথিবীজুড়ে পেশীশক্তি এখন ওভাররেটেড! আপনার চারপাশে বইতে থাকা হাওয়া ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের চেয়ে উত্তম কিছু নাই। এই দেশে আওয়ামী লীগ উল্লেখযোগ্য কিছু বিনিয়োগ না করেই এই গোষ্ঠীর আকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে গেছে! ব্যাপারটা এই না যে, তারা খুব ভালবেসে আওয়ামী লীগের কাছে ভিড়েছেন, বরং গত ৫৪ বছরে তাদের যাওয়ার মত আর কোনো জায়গা ছিল না বলেই তারা আওয়ামী লীগের কাছে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
কিন্তু ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের বিপরীতে যখন মতিঝিলকে দাঁড় করানো হলো, তখন থেকে নাস্তিক ব্লগারদের হত্যাকে জায়েজ ঘোষণার পর তারা বুঝতে পারল যে, তারা কতটা অসহায়! আওয়ামী লীগ তাদের সাথে প্রকাশ্যে বেইমানি করেছে! ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু সংবিধানে রেখে, কার্যত আওয়ামী লীগ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছে!
একদিকে বাছাই করা কতিপয় সাংস্কৃতিক গুন্ডারা সংস্কৃতির নামে দেদারসে লুটপাট করেছেন, আর অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গোড়ায় পানি ঢেলেছে আওয়ামী লীগ। ধর্মকে রাজনীতির সাথে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটা এই দেশে শেখ হাসিনা হাতেকলমে দেখিয়ে গেছেন! যার ফলশ্রুতিতে, দেশে মাদ্রাসা-মসজিদের নামে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢুকেছে! ধর্মনিরপেক্ষতা কপচাতে থাকা একটা দল বছরে ২ কোটি টাকা একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণার জন্য দিতে পারেনি; কিন্তু ৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মডেল মসজিদ বানিয়েছে!
শুধু হেফাজতকে হাতে রাখার জন্য হেলিকপ্টার ভরে টাকা হাটহাজারিতে গেছে। গণিমতের মালের মত রেলের জমি লুটপাট করছে! উনি নিজে (শেখ হাসিনা) ‘কওমি জননী’ উপাধি পেয়েছেন। ৫ আগস্ট আমরা দেখেছি, মাথায় টুপি পরে উনার কওমি সন্তানরা মুজিবের মাথায় বসে পেচ্ছাব করেছেন!
গণজাগরণ মঞ্চের পর যখন অন্তত ছয়জন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে, তখন বাকি নাস্তিক ব্লগারদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা ছিল না। তাদের একটা অংশ জীবন বাঁচাতে লীগে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন, বাকিরা, যাদের আত্মসম্মান আছে, দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ চিরকাল ক্ষমতায় থাকেনি। তাদের পতন হয়েছে! অনেক উপরে উঠে গিয়েছিল বলেই পতনের শব্দটা এত প্রবল হয়েছে! কিন্তু গত ১০ বছর যাদেরকে পেলে-পুষে শেখ হাসিনা বড় করেছেন, গত এক বছর তাদের দৌরাত্ম আমরা দেখেছি! যাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমরা এক সময় লড়েছি, ছাড়া পাওয়ার পর মত প্রকাশ করতে শুরু করার পর তাদের কর্মকাণ্ড আমরা দেখেছি।
ফলে এই দেশে ইসলামপন্থী ছাড়া বাকি সকল স্তরের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা চূড়ান্তভাবে খর্ব হয়েছে। এই স্তরে শুধু অন্যান্য ধর্মাবলম্বী না, আছে আদিবাসী, হিজড়া, অন্যান্য লিঙ্গীয় বিশ্বাসের মানুষ! আর নাস্তিক বা অবিশ্বাসীদের কথা নাইবা বললাম! নিজেকে অবিশ্বাসী হিসেবে ঘোষণা করা এখন প্রায় অসম্ভব স্তরে পৌঁছে গেছে। এর অবদান গোটাটা আওয়ামী লীগের!
ঠিক এরকম এক সময়ে তারেক রহমান তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন যে, বাংলাদেশটা শুধু বিশ্বাসীদের না, অবিশ্বাসীদেরও! উনি এটা কেন বলেছেন, জানি না! এর পেছনের কারণ আমি বলতে পারব না। কিন্তু এই যে প্রকাশ্যে এমন একটা স্ট্যাটাস উনি দিয়েছেন, পরিষ্কার একটা অবস্থান উনি নিয়েছেন, সেজন্য উনাকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই! এই অবস্থান উনার দলকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাবে! কালচারাল স্তরের মানুষজন নড়েচড়ে বসবে এখন! তারেক রহমানরা সেই বিশ্বাস রাখবেন কিনা; সেটা সময়ই বলে দেবে! তবে গত এক বছরে, বিশ্বাস করার মত উল্লেখযোগ্য কিছু উনারা করতে পারেননি!
আওয়ামী লীগের জন্য একটা উপদেশ দিয়ে লেখাটা শেষ করি!
যদি কোনোদিন আওয়ামী লীগ ফিরতে পারে, তবে কাউকে গালিগালাজ করে, অপপ্রচার দিয়ে, অশালীন ভিডিও বানিয়ে ফিরতে পারবে না, ফিরবে এই দেশের লাখো প্রগতিশীল, ‘কালচারাল ফ্যাসিস্টদের’ একটা নিরপেক্ষ দেশ গড়ার লড়াই দিয়ে! আশ্চর্যজনকভাবে, সেই লড়াইয়ের ফল পুরোটা যাবে আওয়ামী লীগের ভাগে! মাদ্রাসার হুজুর, ধর্মপন্থীরা কোনোদিন আপনাদের ভোট ব্যাংক ছিল না, আজও নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। আপনাদের ভবিষ্যত লেখা আছে ধর্মনিরপেক্ষতায়! লিখে রাখেন।
রাজু নূরুল: লেখক, অনুবাদক, গবেষক; যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com