রবীন্দ্রনাথ: এক জীবনে কত জীবন
- রাজু নূরুল
- প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৫, ০৫:২৬ PM , আপডেট: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১১:৩০ AM
আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে জগদীশ চন্দ্র বসু এক অমর ও অনন্য নাম। তিনি ছিলেন মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তির অন্যতম পথপ্রদর্শক, যার সফল গবেষণার ফলেই ভবিষ্যতে রেডিও আবিষ্কারের পথ সুগম হয়। তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাইক্রোওয়েভ রিসিভার ও ট্রান্সমিটারের উন্নয়ন এবং ক্রেসকোগ্রাফ নামের এক বিস্ময়কর যন্ত্র, যা দিয়ে গাছের বৃদ্ধি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা সম্ভব।
জগদীশ চন্দ্র বসু শুধু একজন বিজ্ঞানীই ছিলেন না, ছিলেন মানবিক চিন্তার ধারকও। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যখন তিনি একের পর এক গবেষণা প্রবন্ধ লিখে পশ্চিমা বিশ্বে আলোড়ন তুলছিলেন, তখন ভারতবর্ষে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটিরই প্রকৃত অর্থ বুঝে উঠতে পারেনি অনেকেই। এ সময় ভারতীয়দের কাছে বিজ্ঞানের চর্চা ছিল প্রায় অকল্পনীয়; কিন্তু জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করে দেন, মেধা, অধ্যবসায় ও সাহস থাকলে ভারতীয়রাও বিজ্ঞানজগতে ইতিহাস গড়তে পারে।
সেই সময় ভারতীয়রা দুই কলম ইংরেজি শিখবে, তারপর ইংরেজদের অধীনে গোমস্তাগিরি কিংবা সেরেস্তাগিরি করবে! ভারতীয়রা আবার বিজ্ঞানের কী বোঝে! কিন্তু জগদীশ যে অন্য জিনিস! কিন্তু দুই চারটা পেপার আর সেমিনারে বক্তৃতা দিলে তো হবে না, দরকার পূর্ণাঙ্গ গবেষণা। এরজন্য কাড়িকাড়ি টাকা লাগবে! সেই টাকা আসবে কোথা থেকে?
জগদীশ বিলেত থেকে চিঠি লিখেন বন্ধু রবীন্দ্রকে। টাকা না থাকলে টিকতে পারব না এখানে! রবীন্দ্র নিজেই তখন ধারদেনায় জর্জরিত। কিন্তু তাই বলে বন্ধুর গবেষণা কি আটকে থাকবে? রবীন্দ্রনাথ চলে যেতেন ত্রিপুরার রাজার কাছে। বীরচন্দ্র মাণিক্যের পুত্র রাধাকিশোর তখন রাজা হয়েছে। পিতার মতো তিনিও রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভক্ত! যখনই হাত পাততেন কবি, রাধাকিশোর নিরাশ করতেন না। এরপর সেই টাকা চলে যেত জগদীশ বসুর কাছে।
রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যখন জাহাজ ব্যবসায় মার খেয়ে ঘরে ঢুকে পড়েন, তখন তাদের বাবা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছ থেকে জমিদারিও কেড়ে নেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়োজিত করেন জমিদারি দেখাশোনার জন্যে। কবির বয়স তখন মাত্র ২৯ বছর। এই বয়সে বিশাল বড় জমিদারি দেখাশোনা করতেন তিনি। সঙ্গে লেখালেখিতো আছেই।
ওই বয়সেই তিনি দুই তিনটা পত্রিকাও এক সাথে সম্পাদনা করেছেন। কিন্তু পত্রিকায় লেখার জন্য লেখক পাবে কোথায়? কবিকেই তখন নানা নামে, নানা ধরনের লেখা লিখে পাতা ভরাতে হতো।
তরুণ বয়সেই গ্রামীণ সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘শ্রীনিকেতন’। মধ্যবিত্ত বাঙালির সাংস্কৃতিক এবং মননগত বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিদ্যালয়। তৎকালীন পূর্ববাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে দরিদ্র প্রজাদের ভাগ্যোন্নতির জন্য তিনি সমবায় ব্যাংক, সমবায়নীতি ও কল্যাণবৃত্তি চালু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন হেলথ্ কোঅপারেটিভ্ সোসাইটি ও কৃষি ল্যাবরেটরি।
বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করে বাংলার কৃষিউন্নয়নের জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজ পুত্র ও জামাতাকে কৃষিবিদ্যা বিষয়ে পড়তে বিদেশে পাঠান। বাংলার কুটিরশিল্পের উন্নয়নেও কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। পল্লীসংগঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি চালু করেন হিতৈষীবৃত্তি ও কল্যাণবৃত্তি।
শিলাইদহে তিনি দাতব্য চিকিৎসালয় এবং পতিসরে বড় হাসপাতাল তৈরি করেন। ক্ষুদ্র ঋণ নামের যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা আজ দেখি ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে সেটাই ‘পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক’ নামে প্রতিষ্ঠা করেন। এই চিন্তার জন্য একশ বছর পর ডক্টর ইউনুস ও গ্রামীণ ব্যাংককে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। সেই সময়ে চাষের জন্যে পতিসরে কৃষকদের জন্য ট্রাক্টর নিয়ে আসেন, ভাবা যায়?
নোবেলের পুরস্কারমূল্য ছিল ১ লক্ষ ৮ হাজার টাকা। রবীন্দ্রনাথ পুরস্কারের প্রায় সিংহভাগ দিয়ে দিলেন পতিসরের কালীগ্রাম কৃষিব্যাংকে। বাকি যা থাকল, ঢেলে দিলেন বিশ্বভারতী তৈরির কাজে।
জীবদ্দশাতেই আরববিশ্বে রবীন্দ্রনাথ অনূদিত ও প্রশংসিত হয়েছেন। আরবে রবীন্দ্রনাথের প্রথম অনুবাদক সম্ভবত লেবানি কবি উয়াদি আল-বুস্তানি (১৮৮৬-১৯৫৭)। তিনি ১৯১৪ সালে ভারত আসেন এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কয়েকদিন কাটান।
এর প্রায় এক দশক পর তানিয়াস আবদুহ-এর অনুবাদে কায়রো থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালের মে মাসের ২৭ তারিখ মিশর সফরে যান রবীন্দ্রনাথ। সফরকালে তিনি দেশটির প্রধান প্রধান কবি ও লেখকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রবীন্দ্র-অভ্যর্থনা এই পর্যায়ে যায় যে সেদিনের সংসদীয় অধিবেশন মুলতবি রাখা হয়।
মিশরের পর ইরানের রাজা রেজা শাহ’র বিশেষ আমন্ত্রণে তিনি ১৯৩২ সালে ইরানের তেহরান সফর করেন। একই বছর তিনি ইরাক সফর করেন। কয়েকজন প্রখ্যাত ইরাকি কবি তাঁকে উৎসর্গ করে কবিতাও রচনা করেন।
পাবলো নেরুদা তাঁর তারুণ্যে এই বাঙালি কবির প্রেমে পড়েন। নেরুদার প্রথমত উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বিশটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান-এ তরুণ নেরুদা তার ১৬তম প্রেমের কবিতায় একটি অন্বয় সংযোজন করেন, যা অনেক সমালোচক এ-ও মনে করে যে, এটি ঠাকুরের মালি কাব্যগ্রন্থের ৩০তম কবিতা: ‘তুমি সন্ধ্যারো মেঘোমালা’-এর একটি প্রচ্ছন্ন অনুবাদ।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাবিষয়ক চিন্তা লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোস্টারিকায় সংস্কৃত বিশারদ সল আরগুয়েলোর কোস্টারিকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ বছর রবীন্দ্রনাথের উপর এক আলোচনাসভা পরিচালনা করেছিলেন যেখানে ছাত্রছাত্রীরা এই রবীন্দ্রনাথকে শুধু পঠন-পাঠনই না, তাঁর কিছু নাটক মঞ্চস্থও করেছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এক জীবনে একটা মানুষ সারা দুনিয়া ঘুরে ফেলেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনা কত কত দূরে! এখনও সেখানে যাওয়া প্রচন্ড ব্যয়বহুল। অথচ প্রায় একশ বছর আগে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।
আমার জীবনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী মানুষ, কবিগুরুর আজ মহাপ্রয়াণ দিবস। তাঁর প্রতি প্রণতি।
রাজু নূরুল: লেখক, অনুবাদক ও গবেষক
যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com