বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কার জরুরি ছিল, যা অবহেলিতই আছে
- অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
- প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:১৬ PM , আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৫, ০৩:৪৬ PM
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত রাখা মানে রাষ্ট্র পরিচালনার সব স্তরে স্বৈরাচারী হওয়ার শিক্ষা চালু রাখা। আগামীতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, সে দেখবে- আরে বাহ্ একজনকে নিয়ন্ত্রণ করলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণের অধীনে চলে আসে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কার অত্যন্ত জরুরি ছিল, যা সম্পূর্ণ অবহেলিত হয়ে আছে।
প্রথমত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একটি প্রশাসনিক পদ। ভিসির কাজ ফান্ড আনা, শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ তৈরি করা, অবকাঠামো নির্মাণ করা, লাইব্রেরির মান বৃদ্ধি করা, বিদেশি শিক্ষক ও বিদেশি পোস্ট-ডক নিয়োগের রাস্তা তৈরি করা, ছাত্রদের উন্নত আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন একটা সম্পূর্ণ অ্যাকাডেমিক এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের কাজ। শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশনের সাথে ভিসি প্রোভিসিদের কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা থাকা উচিত না। দুনিয়ার কোন উন্নত দেশে ভিসিরা শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন কমিটিতে থাকে না।
আমাদের দেশে ভিসির ক্ষমতা অসীম হওয়ায় সেখানে নিজ পছন্দের শিক্ষকদের নিয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠিত হয়। আর যে কমিটিতে ভিসি স্বয়ং থাকেন, সেখানে তার পছন্দের সদস্যদের তেমন কোনো মতামতই কখনো থাকে না। একটি বিভাগে একজন যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের গুরুত্বটা কি আমরা টের পাই?
ধরুন একটি বিভাগে জামাল নজরুল ইসলাম বা অশোক সেনের মতো কেউ নিয়োগ পেল, তাতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের মান মর্যাদা অন্য উচ্চতায় উঠে যায়। শিক্ষক নিয়োগ যেহেতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু এটি সংশ্লিষ্ট বিভাগের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মানের সার্চ কমিটি করে এর নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও উন্নত করতে অন্তত তিনটি স্তরে ফিল্টারিং পদ্ধতিতে হওয়া উচিত।
ভিসিদের যদি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত করা যায়, তাহলেই তাদের অনেক সময় বেঁচে যাবে, যা তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজের উন্নয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে পারেন।
গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া কেমন হওয়া উচিৎ, তা নিয়ে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির অভিমত পড়লাম। বিনয়ের সাথে উনার আমি দ্বিমত করছি। ইন ফ্যাক্ট, আওয়ামী লীগ সরকারের গঠিত ইউজিসির চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা সমন্বিত শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালার মাধ্যমে এটিই করতে চেয়েছিলেন। আমি এর বিরুদ্ধে অনেক লিখেছি। লিখিত পরীক্ষা মানে প্রশ্ন তৈরি কে করবে, সেটা স্বচ্ছ নয়।
আমি শুনেছি ভিসি নিজে প্রশ্ন তৈরি করে নিজের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে নিজের পছন্দের প্রার্থীকেই শুধু পাস করায়। এমন প্রশ্ন করা হয় যার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। উন্নত বিশ্বের সেরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে কোথাও উলিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয় এমন শুনিনি। লিখিত পরীক্ষা হতে পারে স্কুল কলেজের শিক্ষক নিয়োগে বা সরকারি কর্মচারী কিংবা কর্মকর্তা নিয়োগে।
আরো পড়ুন: শিক্ষায় যেটা বেশি জরুরি, সেটাতেই বেশি অবহেলা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ হয় গবেষণার মানের ভিত্তিতে। সেটা ঠিক করেন ওই বিষয়ের ওই ফিল্ডের বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া সেমিনার লেকচার ও ইন্টারভিউ এর ভিত্তিতে হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া ইউনিভার্সাল না করলে উন্নত মানের ইউনিভার্সিটি গড়া অসম্ভব।
আওয়ামীলীগ সরকার ১৪ বছরের টানা শাসনামলে একজনও যোগ্য শিক্ষক খুঁজে নিয়োগ দেয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম ভিসি নিয়োগ পেয়েছিল গত ১৪ বছরে। শিক্ষক নিয়োগের বদলে ভোটার নিয়োগ সম্ভব হয়েছিল এই নিয়োগ পদ্ধতির কারণে।
তাই সব সংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদ্ধতির সংস্কার। একটা ভালো শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া তৈরী করলে দেশের ভিবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত করা যেত। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর কি হতে পারে?
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
(ফেসবুক থেকে নেওয়া