রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের যত্নে সুকৌশল জরুরি

লেখক
লেখক  © টিডিসি ছবি

বিভিন্ন সমীকরণকে সামনে রেখে বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) চূড়ান্ত সুপারিশে আগামী ২০২৪ সাল নাগাদ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করবে বাংলাদেশ। যেখানে প্রথম শর্ত ছিল মাথাপিছু আয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার। যদিও এমন শক্ত চ্যলেঞ্জ মোকাবিলা করা একদিন কিংবা একবছরে অর্জিত হয়নি। বরং এর পেছনে রয়েছে দেশের কোটি নাগরিকের অক্লান্ত প্রচেষ্টা এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।

এই অর্জনের পেছনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অন্যতম কারিগর। যেখানে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবাহ ধরে রাখতে আমাদের দেশে প্রবাসী আয় অন্যতম ভূমিকা পালন করে। দেশের এমন কোনো দুর্যোগ নেই, যখন প্রবাসীরা দেশের মানুষের সেসকল সংকটময় মুহূর্তে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে চুপচাপ বসে থেকেছেন। ব্যক্তিগতভাবে বা সম্মিলিতভাবে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে প্রবাসীরা দেশের স্বজনদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে অবদান অনুযায়ী প্রবাসীদের যত্নে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। তাই স্বদেশ নিয়ে প্রবাসীদের অভিযোগ ভারী। দেশে প্রবাসীরা সকল সময়ে অবহেলার শিকার। গুরুত্বহীন। প্রবাসী যারা দেশ ছেড়েছেন, দেশের প্রতি তাদের টান, ভালোবাসা সব সময়ই আছে। সংকটে পাশে থেকে সেটারই প্রমাণ দিয়েছেন তারা। 

বাংলাদেশের নাগরিকরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গমন করেন। এরমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের কর্মসংস্থান রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতারসহ দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে কর্মসংস্থান হয়েছে। মালদ্বীপে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশী শ্রমিক। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে অতীতে লিবিয়ায় বাংলাদেশী অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছিল। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কার ও মরিশাসের পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের বেশ কিছু শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এদের অধিকাংশই দক্ষ। ইউরোপের কিছু কিছু দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সর্বোপরি পৃথিবীর দূরদূরান্তের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পেশায় বাংলাদেশী বিপুলসংখ্যক শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে। যারা প্রতিনিয়ত রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশ এবং আপনজনের পাশে দাড়িয়ে আছে। অন্য যেকোনো রপ্তানি আয়ের তুলনায় বাংলাদেশের জিডিপির বৃহদাংশ প্রবাসী আয়ের উপরে নির্ভর করে। কেননা বিভিন্ন পন্যের রপ্তানি আয়ের মধ্যে কাঁচামাল ক্রয় বাবদ বৃহদাংশ ডলার চলে যায়। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানি খাত এমনই এক অর্থনৈতিক খাত যার উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। একই সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানি খাত দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা নিরসনে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে। এরা যদি বিদেশে কর্মসংস্থানে যেতে না পারত তাহলে দেশের বেকার সমস্যা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করত। 

তবে যে কারণে দেশ এবং আপনজনের মায়া ছেড়ে তারা প্রবাসী হয়েছেন, সে কারণে তাদের নিজেদের চেয়ে দেশই যে বেশি উপকারভোগী হয়েছে, এই বাস্তবতাটা দেশের নীতিনির্ধারণী মহলে স্বীকার করতে দেখা যায় না। প্রবাসী আয়ের উপর ভর করে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে। দরিদ্র, স্বল্পোন্নত শ্রেণী থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনে এটি অন্যতম কারণ। 

বৈশ্বিক শ্রমবাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, চীন, নেপাল, ফিলিপাইন এবং শ্রীলঙ্কা। যেখানে এসব দেশের শ্রমিকরা আমাদের দেশের তুলনায় বেশি দক্ষ। বিশ্ব শ্রমবাজারে আমাদের পাল্লা দিতে হলে অবশ্যই দক্ষ শ্রমিক তৈরি ও নিয়োগে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথ সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই প্রবাসী হতে গিয়ে কত দুর্ভোগ! দালাল চক্রের ধাপ্পাবাজি, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কত রকম প্রতারণা এতোসব বুকে আগলে নিয়ে দেশের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছেন প্রবাসীরা।

একই চিত্র যেমন দেশে ঠিক তেমনি প্রবাসেও শ্রমিকেরা নানারকম দুর্ভোগ এবং অবহেলার স্বীকার হতে হয়। এমনকি প্রবাসীদের জীবনেরও যেন তেমন কোন মূল্য নেই। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও তিন বিমানবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক দশকে ৩৩ হাজার ৯৯৮ প্রবাসী শ্রমিকের বিদেশে মৃত্যু হয়েছে। 

শুধুমাত্র ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত এক হাজার ৭৪৫ জন প্রবাসীর মরদেহ এসেছে। যাদের ২০ দশমিক ১২ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে অপঘাতে। যদিও এসকল মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলা হচ্ছে, সেগুলোও সন্দেহমুক্ত নয়। অপমৃত্যুর শিকার কর্মীদের গড় আয়ু আরও কম। বাংলাদেশে অভিবাসন খাত নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, প্রবাসে মারা যাওয়া শ্রমিকদের বড় একটি অংশের মৃত্যু ঘটে স্ট্রোকে। এরপর রয়েছে হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যা। কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু ও সড়ক দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, আগুনে পুড়ে মৃত্যু, আত্মহত্যা বা খুন। প্রবাসীদের এমন আকস্মিক মৃত্যুর কারণও দেশ থেকে খতিয়ে দেখার সুযোগ হয়না। ফলে লাশের সঙ্গে আসা মেডিকেল রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করা হয় সেটাই চূড়ান্ত হিসেবে ধরা হয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৭০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে কাজ করেন। এ হিসাবে ২০২২ সালে হাজারে ৫ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে বিদেশে। বিদেশে চাকরিতে যান সাধারণ ত১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা। তারা দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হন। কর্মক্লান্তিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। টিকমতো তারা চিকিৎসাও পান না।

কিন্তু আরও মজার৷ বিষয় হলো দেশের এই বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে সরকারকে কোন অর্থ খরচ করতে হয় না। কর্মীরাই সব খরচ বহন করেন। যেখানে দালালের বাড়তি অর্থসহ সব ধরনের ফি এবং মাত্রাতিরিক্ত প্লেন ভাড়া বহন করেন। 

কাজেই সময় এসেছে অতিসত্বর প্রবাসীদের যথাযথ সম্মান প্রদান এবং নানাবিধ সুবিধা নিশ্চিতে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে আরও বেশি যত্নশীল হবার। প্রবাসীদের কল্যাণে প্রবাসীকল্যাণ শাখা নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। নিঃসন্দেহে সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। প্রবাসীকল্যাণ শাখাকে আরও গতিশীল করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রবাসীদের সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন খাতে আমরা অনেক এগিয়েছি। তাই অভিবাসীদের সমস্যাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একই। কিন্তু তাদের জন্য আমরা কিছু করতে পারছি না। অভিবাসীদের নিয়ে আমাদের সফলতাও রয়েছে। বিদেশফেরত অনেকে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন। নিজেরা উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা করা প্রয়োজন। 

অনেকে নতুন প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসা শুরু করতে চান; কিন্তু সহযোগিতার অভাবে আবার বিদেশে চলে যান। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ঋণ দিতে ভয় পায়। দেশের মধ্যে এসব মানুষের কর্মসংস্থান নেই। এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। কর্মসংস্থানের জন্য তারা বিদেশে পা রাখছেন। রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। অনেক নারী ছয় মাস, এক বছরের বাচ্চাকে রেখে কাজ করার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। এসব বাস্তবতা আমাদের স্বীকার করতে হবে। অভিবাসীদের শুধু আর্থিক বিষয়টি বিবেচনা না করে মানবিক বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। বিদেশে যাওয়া থেকে শুরু করে ফেরত আসা পর্যন্ত সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক দুর্বলতা রয়েছে। এখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত।

 এখানে স্বচ্ছতার জন্য প্রশাসনের বড় উদ্যোগ প্রয়োজন। দালালদের নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা গেছে, ৯৭ শতাংশ কাজ দালালের মাধ্যমে করা হয়। অভিবাসী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ, ভিসা প্রসেসিং ইত্যাদি কাজ দালাল করে থাকেন। এ জন্য এই শ্রেণির মানুষগুলোকে একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা উচিত। দেশের বাইরে ৩৯ শতাংশ অভিবাসী দালালের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হন। শ্রমিকদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা, বেতন ইত্যাদি ঠিকমতো দেওয়া হয় না। এসব বিষয় রাষ্ট্রকে খতিয়ে দেখতে হবে। অদক্ষ শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করতে হবে। এতে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। সর্বোপরি সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে অভিবাসীদের দুর্দশা কমবে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত। অভিবাসীরা ভালো থাকলে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। তাদের সুযোগ-সুবিধাগুলো দেখা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence