কেনিয়ার ভয়ঙ্কর গণ-আত্মহত্যার ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন

জাহাঙ্গীর এইচ মজুমদার
জাহাঙ্গীর এইচ মজুমদার  © টিডিসি ফটো

কেনিয়ার শাকাহোলা জঙ্গলে এ প্রবন্ধ র সময় পর্যন্ত, শতাধিক মৃতদেহ পাওয়া গেছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে কেননা আরও শতাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছে। ভাবতে পারেন, এ রকম নিউজ তো হরহামেশাই আসে। বিশেষ করে দারিদ্র ও সংঘাত পীড়িত আফ্রিকা মহাদেশ হলে তো কথাই নেই। সেখানে এমন মৃতদেহ পাওয়ার ঘটনা অনেককে অবাক করে না। সেখানকার বিভিন্ন দেশের আন্তরাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন চক্র এ ধরণের ঘটনার সাথে জড়িত। যেমন নাইজেরিয়ায় বোকোহারাম গোষ্ঠী প্রায়ই লোকালয়ে হামলা করে মানুষ তুলে নিয়ে যায় বা হত্যা করে লাশ ফেলে যায়।

তবে এবারের ঘটনাটি একটু ভিন্ন ধাঁচের। যেসব মানুষ মারা গেছেন তাদের কেউ অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেনি। খাবারেও বিষ প্রয়োগ করেনি তবে, বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে চিন্তা-চেতনায়। ভাবাদের্শের বিষ আক্রান্ত এই অনুসারীরা তথাকথিত ‘অনাহারী উপাসনা’র মাধ্যমে গণ-আত্মহত্যায় মেতে উঠেছেন। অনাহারী জীবিত উদ্ধার হওয়া ২৯ জনও স্বর্গ যেতে বিলম্ব করতে চাচ্ছেন না। কেনিয়ার রাষ্ট্রপতি এটিকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছেন।

এ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল কেনিয়ার পল ম্যাকেঞ্জি নামক এক খ্রিস্টান ধর্ম যাজকের কিলিফি শহরে নতুন একটি সেক্ট বা কাল্ট গড়ে তোলার মাধ্যমে। যদিও সেক্ট ও কাল্টের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এখানে সমার্থক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত গ্রুপটি কিলিফি কাল্ট বা কিলিফি ধর্মমত হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। ম্যাকেঞ্জি শিশুদের পড়াশোনাকে শয়তানের কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সচেতন মানুষ অভিযোগ করেছেন সে বাইবেলের ভুল শিক্ষা দিয়ে  শিষ্যদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে।

উগান্ডা, তাঞ্জানিয়া ও কেনিয়ার কিলিফি সম্প্রদায়ের অনুসারীরা স্বঘোষিত ধর্মগুরু ম্যাকেঞ্জির মায়াবী প্ররোচনায় সম্মোহিত হয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আবেগিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে এবং স্বর্গ ও যিশুখ্রিষ্টকে পাওয়ার আশায় শাকাহোলা জঙ্গলে অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে তীব্র যন্ত্রণার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল চার জনের মৃতদেহ পাওয়ার পর এই ঘটনা উদঘাটিত হয়। মরণোন্মুখ অবস্থায় জীবিত উদ্ধারকৃতরা জানিয়েছেন, ম্যাকেঞ্জি তাদের বলেছেন, অনাহারী উপাসনা করতে করতে মারা গেলে যীশু খুশি হয়ে তাদের সাক্ষাৎ দেবেন। এ ঘটনা উদঘাটনের পূর্বে মৃতদের অনেকের পরিবার সদস্যদের হারিয়ে যাওয়ার রিপোর্ট করেছে। হারিয়ে যাওয়াদের কেউ কেউ যীশুর সাথে সাক্ষাত করতে যাচ্ছেন বলে বাড়িতে গোপনে ফোন ও মেসেজ রেখে গেছেন।

উপবাস শিখ ধর্ম ব্যতীত প্রায় সকল ধর্মের একটি সাধারণ প্রথা। তবে অনাহারে মৃত্যুর প্রথা অন্য কোনো ধর্ম দেখা না গেলেও, ভারতের অন্যতম প্রাচীন জৈন ধর্মে দেখা যায়। জৈন ধর্মে ‘সানথারা’ নামে উপবাসে এই স্বেচ্ছামৃত্যু আইনসিদ্ধ। তবে সেখানে গণ-আত্মহত্যার ঘটনার কথা জানা যায় না। সাধারণভাবে কোনো এক জন ব্যক্তি পরিবারের সমর্থন নিয়ে পরিবারে থেকেই দীর্ঘ উপবাসে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে থাকে। যেমন, ২০২১ সালের শেষের দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতিদেবী সুরানা (৮৭) ১৯ দিন ঠায় বসে থেকে উপবাসে মৃত্যুবরণ করেন। এ ধর্মে মৃত্যুর উদ্দেশ্য ছাড়াও, কোনো লক্ষ্য অর্জনে ৮, ১০ দিন বা মাসব্যাপী উপবাসের কঠোর তপস্যার আচার রয়েছে। ২০১৬ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদে জৈন ধর্মাবলম্বী আরাধনা সামদারিয়া (১৩) নামে এক কিশোরী, তার বাবার গুরুর পরামর্শে স্বর্ণ ব্যবসায় উন্নতির জন্য টানা ৬৮ দিন উপবাস করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

খ্রিষ্টান ধর্মমতে উপবাসে আত্মহত্যার নির্দেশনা না থাকলেও পল ম্যাকেঞ্জি তার অনুসারীদের দিয়ে তা করান। এই সেক্ট প্রধান ১৯৯০-এর দশকে কেনিয়ার উত্তর উপকূলের শহর মালিন্ডিতে ট্যাক্সি চালিয়ে জীবন ধারণ করতেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে তিনি ধর্ম প্রচারের কাজে নেমে পড়েন এবং প্রতিষ্ঠা করেন গুড নিউজ ইন্টারন্যাশনাল চার্চ। ২০১৮ সালে স্থানীয় জনতা বাইবেলের মিথ্যা শিক্ষা ছড়ানোর অভিযোগে তার গির্জা ও এক যাজকের বাড়ি ভাংচুর করে। বিভিন্ন সময়ে তিন বার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি আবার একই কাজে লিপ্ত হন।

আরও পড়ুন: অনার্স শেষে এমআইটিতে পিএইচডি করতে যাচ্ছেন বুয়েটের ৩ শিক্ষার্থী

পরবর্তীতে ২০১৯ সালে তার কাজ শেষ হয়েছে মর্মে ঘোষণা দিয়ে চার্চ বন্ধ করে দেন। এরপর কৃষিতে মনোযোগের কথা বলে তিনি শাকাহোলায় ফিরে আসেন। সেখানে ৮০০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠা করেন তার নিজস্ব অঞ্চল। সে এলাকাটিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটে ভাগ করে বাইবেল থেকে নাম নিয়ে নামকরণ করে তিনি ধর্ম-ভিত্তিক প্রশাসনিক ইউনিট প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভক্তদের অনাহারে স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেও  যাজক ম্যাকেঞ্জি ও তার স্ত্রী দিব্যি বেঁচে আছেন।

কোনো সেক্টরে অনুসারীদের এভাবে আত্মাহুতির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। অতীতেও ধর্মগুরুরা এই রকম মগজ ধোলাই করে অনুসারীদের গণমৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। এ ধরনের প্রথার কবলে পড়ে ১৮৪০-এর দশকে ব্রিটিশ গায়ানাতে প্রায় ৪০০ মানুষ স্বেচ্ছায় একে অপরকে খুন করে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালে ১৯৪১ সালে যোগমায়া নউিপনে এবং তার ৬৭ শিষ্য নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ‘জলসমাধি’ বা আত্মহত্যা করেন। ১৯৭৮ সালে গায়ানার জন্সটাউনে জিম জোনসের নেতৃত্বে পিপলস টেম্পলের ৯১৮ জন সায়ানাইড গ্রহণে গণ-আত্মহত্যা করেন।

কানাডার কুইবেক ১৯৯৪-১৯৯৭ সময়ে সোলার টেম্পলের ৭৪ জন পৃথিবীর কপটতা ও নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে গণ-আত্মহত্যা করেন। কাছাকাছি সময়ে ১৯৯৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় হেভেনস গেইটের ৩৯ জন অনুসারী নশ্বর দেহ হতে আত্মাকে মুক্তি দিতে আত্মহত্যা করেন। তখন, কেউ কেউ আবার কথিত জেন্ডারবিহীন জগতে প্রবেশের জন্য আত্মহত্যার পূর্বে নিজেকে খোঁজ করে নেন। ২০০০ সালে উগান্ডায় রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে বিচ্যুত হওয়া ঈশ্বরের দশ আদর্শে পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন-এর ৭৭৮ জন অনুসারীও তাদরে ধর্মগুরুর প্ররোচনায় আত্মহত্যা করেন। যদিও ঘটনাটির বয়ান নিয়ে বিতর্ক আছে- হত্যা নাকি আত্মহত্যা।

বাংলাদেশেও এ রকম একটি ঘটনার কথা জানা যায়। ২০০৭ সালের সে ঘটনায় প্রচলিত ধর্মমত হতে বিচ্যুত আদমের কাল্ট-এর অনুসারী একই পরিবারের নয় জন সদস্য ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি দেন। ভারতে ২০১৮ সালে এই রকম একটি ঘটনার নজির পাওয়া যায়, সেখানে একই পরিবারের ১১ জন আত্মহত্যা করেন।

এভাবে ধর্মীয় কোনো ক্যারিশমেটিক নেকার মায়াজালে বন্দী হয়ে দুর্বোধ্য কারণে করা গণ-আত্মহত্যাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হলেও অনেক সময় কোনো হুমকি, রাজনৈতিক প্রতিবাদ, বশ্যতা মানতে অস্বীকার, বা গণ-হতাশায় পড়ে গণ-আত্মহত্যার ঘটনাকে কোথায়ও কোথায়ও গৌরবের চোখে দেখা হয়। স্বীকৃত ইতিহাসে খ্রিষ্টপূর্ব ২০৬ সালে প্রথম এই ধরণের গণ-আত্মহত্যার ঘটনার কথা জানা যায়। ভারতে রাজপুত নারীদের জহরব্রত পালনের ইতিহাস অবিদিত নয়।

এছাড়া, ফরাসী বিপ্লবের সময়ে ১৭৯২ সালে ক্যারিবীয় অঞ্চলের কলোনিগুলোতে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেও পরবর্তীতে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফ্রান্স ১৮০২ সালে দাসপ্রথা পুনঃপ্রর্বতন করতে চাইলে ৪০০ এর বেশি দাস গানপাউডারের গুদামে আগুন ধরিয়ে তাতে আত্মহত্যা করেন।

আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পেলেন কুবির উর্মি 

উপরের ঘটনাগুলোর ক্রম লক্ষ্য করলে অনুধাবন করা যায় যে, রাজনৈতিক, যুদ্ধ, নির্যাতন বা বশ্যতা স্বীকার না করার অভিপ্রায় থেকে গণ-আত্মহত্যার ঘটনাসমূহ সুপ্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। কিন্তু কাল্ট সিস্টেম বা সাম্প্রদায়িক গ্রুপিংয়ের কারণে গণ-আত্মহত্যার ঘটনাগুলো অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের। সেখানে আমেরিকা, কানাডার মতো উন্নত দেশের উপস্থিত যেমন রয়েছে তেমনি উগান্ডা বা নেপালের মতো উন্নয়নশীল দেশের উপস্থিতিও রয়েছে এ প্রবণতা বুঝতে হলে আমাদের ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদ তত্ত্বকে বুঝতে হবে।

অক্সফোর্ড রেফারেন্স এর ভূক্তিতে বলা হয়েছে, ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদ “তীব্র ধর্মীয় উত্তেজনার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য একটি শব্দ। এটি পর্যায়ক্রমিক ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের সাথে জড়িত ধর্মীয় ঐতিহ্যের একটি নিয়মিত সমাজতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, যা গোষ্ঠীর প্রতি অঙ্গীকার এবং সংযুক্তি পুনরুদ্ধার করতে চায়।”

হোসে কাসেনোভার মতে উত্তরাধুনিক কালে ধর্মের আবেদনের শেষ হয়ে যায়নি। বরং বর্ধিত হারে জন-সমাজে ধর্মের পুনঃপ্রবেশ ঘটেছে। বর্তমানে ধর্ম সমাজের মূল নির্ণায়ক হিসেবে নেই, কিন্তু নতুন এবং ভিন্ন কোনো অচেনা রূপে সমাজে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ফিরে আসছে।

এই প্রবণতাকে বিশদভাবে বুঝতে হলে একটু পেছন থেকে শুরু করতে হবে। মোটামুটি ইউরোপের রেনেসাঁ (Renaissance) বা পুনর্জাগরণের পূর্ব পর্যন্ত, ধর্ম- রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে এর প্রভাব ধরে রেখেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে শিল্পবিপ্লব ও পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশের সাথে সাথে আধুনিকায়নের হাত ধরে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিকাশ হয়। সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড মার্টিন ও জাইলস কেপেল বলেন, বর্তমানে আধুনিক যুগ অতিক্রম করে মানব সমাজ উত্তরাধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে।

একই সাথে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে উত্তর-ধর্মনিরপেক্ষ সমাজেও মানুষের উত্তরণ ঘটেছে। তার মতে পোস্ট-সেকুলার সমাজে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধর্ম পুনরুজ্জীবন লাভ করবে। তবে সেটা মধ্যযুগের বা প্রাচীন যুগের ধর্মচর্চার আদলে নয়। বরং এখানে মূলনীতি ঠিক রেখে নতুন নতুন বিশ্বাস ও আচারের অবতারণা হতে পারে। মৌলবাদী ভাবধারার বিকাশ হতে পারে এবং বিজ্ঞান ও যুক্তিবোধের আবেদনও হ্রাস পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্সের পুনঃখ্রিষ্টিয়করণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিষ্টানদের ইভানজেলিক্যাল নিউ ক্রিশ্চিয়ান রাইট, ইহুদীদের লুবাভিচ ক্যাম্পেইন, ইরানের শিয়া বিপ্লব, ফিলিস্তিনের হামাস, ইরাক-সিরিয়ার আইএস, আফগানিস্তানের তালেবান, ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান এবং শ্রীলংকার বদু বালা সেনা (বিবিএস) বা বুড্ডিস্ট পাওয়ার ফোর্স-এর মতো নতুন ধর্মীয় আন্দোলন বা 

সেক্টস ও কাল্টসের আবির্ভাবের কথা বলা যায়। সেক্ট ও কাল্ট দুটোই মূল ধর্ম হতে বিচ্যুত গোষ্ঠী, যাতে ধর্মগুরুই সর্বেসর্বা। প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি এদের কারাের রয়েছে নেতিবাচক ধারণা, কারোর রয়েছে ইতিবাচকতা, আর কারোর রয়েছে নিরপেক্ষতা।

স্টার্ক ও বেইনব্রিজের মতে তুলনামূলক অপ্রাপ্তি, রে ওয়ালিসের মতে সমাজে ধর্মের বিশুদ্ধিকরণের জন্য, ট্রয়লেশ্চের মতে সমাজের নিচুশ্রেণি রাষ্ট্র ও সমাজের বিরোধিতায়। ম্যাক্সওয়েবারের মতে ধর্মের প্রভাবে জাত প্রান্তিকতার উপর ভিত্তি করে নানারকম সেক্টরে উত্থান ঘটে। বিশেষ করে সমাজের দ্রুত পরিবর্তনের সময় প্রচলিত মূল্যবোধের আঁকড়ে ধরতে গিয়ে সেক্ট বা সম্প্রদায়ের জন্ম হয়। তারা নিজেদেরকে অনন্যভাবে সঠিক মনে করে।

যথা, পূর্ব-আফ্রিকার বঞ্চিত মানুষদের গণ-আত্মহত্যায় স্বর্গযাত্রা। অপরদিকে কাল্ট সাধারণত শিল্পোন্নত সমাজে মোটামুটি শিক্ষিত ও বিচ্ছিন্ন শহুরে মধ্যবিত্ত তরুণ ও যুবকদের মানসিক শান্তির জন্য নতুন ধর্ম ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে উঠে। আধুনিকতার সাথে সাথে কাল্টেরও বিকাশ ঘটতে থাকে। রে ওয়ালিসের মতে, তারা বহুত্ববাদী হয় এবং নিজেদের পাশাপাশি অন্যদের বিশ্বাস সেনে নেয় এবং নতুন সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। মোটের উপর, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘাত, পরিবর্তন, বৈষম্য, প্রান্তিক মানুষদের ভলান্টারি সার্ভিস প্রদান, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, চিন্তাশূন্য গড্ডালিকা প্রবাহ, সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচলিত ধর্ম ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সুযোগ, ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যস্থব্যক্তি হিসেবে ধর্মীয় গুরুর আবির্ভাব এবং শিক্ষার উচ্চহার সেক্টস ও কাল্টেসের বিকাশে ভূমিকা রাকে। তুলনামূলকভাবে সেক্টসের অনুসারীদের অধিকমাত্রায় উগ্র আচরণ করতে দেখা যেতে পারে। তবে বিভিন্ন সমাজে এর মাত্রাগত পার্থক্য লক্ষণীয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলাম, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের নবজাগরণ হয়েছে এবং মূলভাবধারা হতে পথচ্যুত নানা মতের সেক্টস ও কাল্টসের উপস্থিতিও বেড়েছে। প্রত্যেক গ্রুপ নিজেদের স্বতন্ত্র দাবি করছে। উত্তর-ধর্মনিরপেক্ষতার যুগে ধর্মের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উপস্থিতি দেখা যায়। এ কালের মানুষ শিক্ষিত হওয়ায় কোনো ধর্মগুরুর নিকট না গিয়ে নিজেরাই ধর্মচর্চা বা ধর্মের নানা বিষয়ের অনুসন্ধান করে উদাহরণস্বরূপ, শুরুর দিকে উল্লিখিত, বাংলাদেশ ও ভারতের দুইটি ঘটনায় দেখা যায়, এখানে শুধু সংশ্লিষ্ট দুটি পরিবারই বিচ্ছিন্নভাবে তাদের নতুন ধর্মীয় উপলব্ধির সাথে জড়িত। 

যদিও সমাজ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় সেক্টস ও কাল্টসের আবির্ভাব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে আইএসের জন্ম বা কেনিয়ার মতো গণ-আত্মহত্যার মতো কোনো ঘটনা না ঘটে। একটিতে ব্রেনওয়াশড হওয়া ব্যক্তিরা অন্যদের হত্যা করেছে অন্যটিতে নিজেরাই আত্মহত্যা করেছে। এগুলো বন্ধ করতে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের সুনির্দিষ্ট করণীয় রয়েছে। পরিবারকে তার সদস্যদের আচরণের বিচ্যুতির প্রতি লক্ষ্য রেখে কাউন্সেলিংসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সমাজের ক্ষেত্রে নতুন সেক্ট বা কাল্টের গড়ে উঠার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

তাদের মত ও বিশ্বাসকে যেমন স্পেস দিতে হবে, তেমনি তাদের মধ্যে উগ্রতার বিষবাষ্প দেখা দিলে তা রোধেরও উদ্যোগ নিতে হবে। আর রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নজরদারি করা ও তথ্য সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে সরকার নিয়মিতভাবে এসব গ্রুপের উত্থান, কার্যক্রম, ও পরিকল্পনা মনিটরিং করে ইনফর্মড ও এভিডেন্সির-বেইজড নীতি প্রণয়ন করবে।

এসব ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করার চেয়ে ধীরে চলার নীতি ফলদায়ক হতে পারে। উইলিয়াম রিচার্ড স্কটের মতে সমাজে কোনো মতবাদ বা নীতি প্রচলিত ব্যবস্থার বিপরীতে দ্রুত প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা করলে সেটির টিকে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। এছাড়া, গণমাধ্যমে প্রচারণা, শিক্ষা কার্যক্রমে পরিবর্তন, নতুন ন্যাশনাল ডিসর্কোস তৈরি জননিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা, সংঘাত ও বৈষম্য হ্রাস, ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন, আইনের প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি, ধর্মনিরপেক্ষ নীতির চর্চা ও বিশ্বাসযোগ্য ন্যারেটিভ তৈরি করার মাধ্যমে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদ, সেক্টস ও কাল্টসের আবির্ভাব, বিশেষ করে উগ্রবাদকে রোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 

লেখক: ইউজিসির পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence