উর্দুভাষী হয়েও বাঙালির ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন যারা

  © সংগৃহীত

বাঙালি জাতির প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ও উদ্দীপ্ত প্রেরণার নাম ভাষা আন্দোলন।১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্তির পর বাঙালি মুসলিম সমাজের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যের সূচনা হয়, বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানে অস্বীকার করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাভাষীরা উর্দুভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। রাষ্টভাষা বাংলার দাবি ছিলো তৎকালীন ৭ কোটি বাঙালির প্রাণের দাবি, ন্যায্য দাবি। কিন্তু পশ্চিম শাসক গোষ্ঠী বাঙালির এ প্রাণের দাবিকে উপেক্ষা করে। উর্দুকে রাষ্টভাষা রুপে স্বীকৃতি দিয়ে তারা বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক আচারণ শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা বলে ঘোষনা করেন। এর তিনদিন পরে ২৪-মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও তিনি এ কথার পুনরায় উল্লেখ করেন। তখন সেই মুহূর্তে বাংলার জাগ্রত ছাত্র সমাজ এর প্রতিবাদ জানায়। বাংলার প্রাণে আঘাত, আগুন জ্বলে উঠে। সেই আগুন আর নেভেনি।

১৯৫২ সালের ৩০-এ জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এক জনসভায় উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেন। আর সেটা হয় আগুনের শিখায় কেরোসিন ঢালা। বাংলার অপমার জনসাধারণ নতুন করে জেগে উঠে। প্রাণের ভাষাকে, মায়ের ভাষাকে রক্ষায় এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে পূর্ব বাংলার সচেতন ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-জনতা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আন্দোলন, সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। অবশেষে এলো একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশ শো বায়ান্ন সাল। বাঙালির জাতীয় উন্মেষের প্রথম দিন। স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ ।সেদিন পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠীর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলার ছাত্রসমাজ এগিয়ে যায় এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় এলে নিষ্ঠুর শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। ঝড়ে পড়ে কতগুলো তাজাপ্রাণ । বাংলার তরুণের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার পিচ ঢালা কালো রাজপথ। সেদিন এবং পরদিন পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং শফিউর ছাড়াও আরো অনেকে শহীদ হয়েছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়নি। এই আন্দোলনেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মনে এক হওয়ার অনুভূতি সম্ভবত জাগ্রত হবে না।

বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষার প্রশ্নে খাজা নাজিমুদ্দিন,  নুরুল আমিন গংরা ছিলেন বাংলায় 'মীর জাফরের' প্রতিচ্ছবি। ঠিক অপরদিকে, উর্দুভাষী হওয়া সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক উর্দুভাষী ছিলেন বাঙালির ভাষা আন্দোলনের ন্যায্য দাবির পক্ষে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভাষাসৈনিক ড. সৈয়দ ইউসুফ হাসান, জয়নুল আবেদীন, নওশাদ নূরী, হাসান পারভেজ, সালাউদ্দিন মোহাম্মদসহ আরও নাম না জানা অনেকে।

ড. সৈয়দ ইউসুফ হাসান
উর্দুভাষী লেখক ও গবেষক ড. সৈয়দ ইউসুফ হাসান আমাদের কাছে অপরিচিত, বর্তমানে বিস্মৃত একটি নাম। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে উর্দুভাষী এই লেখকের ছিল গৌরবময় ভূমিকা। ইউসুফ হাসান পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক বিপ্লবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিজে একজন লেখক। তাই Writers Association নামে কবি লেখকদের একটি সংগঠন গড়ে তোলার জন্য সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেন। এ সংগঠন প্রগতিশীল ও উঠতি কবি লেখকদের প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। তিনি ছিলেন এ সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারী। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যখন কেবলমাত্র উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নিচ্ছিল পূর্ব বাংলার বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল। ইউসুফ হাসান তখন Writers Association পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানবাসী (বাংলাদেশি)দের দাবি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক বলে পত্রিকায় মতামত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার মর্যাদা রাখে।  ইউসুফ হাসানের অভিমত পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর Pakistan Writers Association (পাকিস্তান কবি লেখক সংঘ) এর সেক্রেটারী জেনারেল আহমদ নাদিম কাশিমী জনাব হাসানের কাছে তাঁর মতামতের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দাবি করেন। ইউসুফ হাসান যথাযথ যুক্তি তর্ক সাপেক্ষে বুঝাতে সক্ষম হন যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা পূর্ব পাকিস্তান জনগণের নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। হাসানের যুক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে জনাব কাশেমী, ইউসুফ হাসানের অভিমত দেশব্যাপী বেতার মাধ্যমে প্রচার করেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের সামনে বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিলে অংশগ্রহণ করায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় এবং অমানবিক নির্যাতন চালায়।

জয়নুল আবেদীন
জয়নুল আবেদীন ওরফে 'জনুভাই' একজন উর্দুভাষী হয়েও বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করেছেন রাজপথে। উর্দুতেই বাংলা ভাষার জয়গান গেয়েছেন তিনি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপক্ষো করে গলা ফাটিয়ে বলেছেন, ‘হামার জবান, বাংলা জবান’। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় এ কর্মী উর্দুতে দেয়াল লিখন ও বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক উক্তি ও শ্লোগান লিখে ঢাকায় বসবাসরত উর্দুভাষীদের বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত করেছিলেন এবং বাংলার পক্ষে জনমত গঠন করেছিলেন।’ শুধু ভাষার প্রশ্নে নয়, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। পাকিস্তান সরকার তা টের পেয়ে তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করে।

নওশাদ নূরী
কবি নওশাদ নূরী একজন  উর্দুভাষী বিহারী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির পক্ষে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার স্পষ্ট সমর্থন ও ‘মহেঞ্জাদারো’ নামে এক সুন্দর কবিতা রচনা করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা প্রথম উর্দু কবিতা নওশাদ নূরীর ‘মহেঞ্জোদারো’। এ কবিতা ছাপা হওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে দেশ ছাড়ার হুকুম দেন। শুধু ভাষা আন্দোলনই নয়, বাঙালির সমস্ত আন্দোলনকেই পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে উর্দু ভাষাতেই কবিতা লিখেন নওশাদ নূরী। ১৯৬৯ সালে তিনি বের করলেন একটি উর্দু পত্রিকা ‘জরিদা’, যার সম্পাদক তিনি নিজেই ছিলেন। বাঙালির আশা আকাক্সক্ষা, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের ইঙ্গিত প্রদান করাই এর পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো আর ৬ ডিসেম্বের এই পত্রিকার প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘তেরি নেজাত মেরি নেজাত; ছে নুকাত ছে নুকাত’, অর্থাৎ( তোমার মুক্তি আমার মুক্তি, ছয় দফা ছয় দফা)। দ্বিতীয় শিরোনাম ছিল, ‘দো হি রাস্তে হ্যাঁয়, আজাদ মাশরাকি পাকিস্তান ইয়া মারকাজ কি গুলামি’, (মাত্র দুটি পথ, স্বাধীন পূর্বপাকিস্তান অথবা কেন্দ্রের দাসত্ব)। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতা আর অত্যচারের উপর কবিতা লিখেছিলেন যার মধ্যে বিখ্যাত হচ্ছে, ‘ছাব্বিশে মার্চ’। কবি নওশাদ নূরী বঙ্গবন্ধুকে অসম্ভব ভালবাসতেন এবং বঙ্গবন্ধুও তাকে অনেক পছন্দ করতেন। বাঙালির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘিরে কাব্যিক যেসব অভিব্যক্তি ইতিহাসে জায়গা করে নিল সেখানে নওশাদ নূরী রেখে গেছেন আর এক স্বাক্ষর তাঁর ‘টুঙ্গিপাড়া’ শীর্ষক কবিতার মাধ্যমে, যা তিনি রচনা করেছিলেন ১৭ আগস্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধুর দাফনের সংবাদ প্রাপ্তির পর পর। 

হাসান পারভেজ
১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা বার এসোসিয়েশন বলে পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কার্যপরিষদের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে উর্দু প্রগতি লেখক হাসান পারভেজ উর্দুতে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছেন: "বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক। তার প্রতি আমাদের কোনো বিদ্বেষভাব থাকতে পারে না। আমরা প্রাণপণে এ-দাবী সমর্থন করে যাবো।"

সালাউদ্দীন মোহাম্মদ
সালাউদ্দীন মোহাম্মদ উর্দুভাষী হওয়া সত্ত্বেও বাঙালির ভাষা আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন শিক্ষার্থী নিয়ামুল বশীর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন- "সে সময়ে আরো বেশ কিছু উর্দুভাষী আমাদের এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। মনে পড়ে, সে সময়ে সালাউদ্দিন মোহাম্মদ এই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ’৫২ সালে আমরা যখন জেলে যাই তখন সালাউদ্দিন মোহম্মদের এক ভাইও কারা বরণ করেন বলে মনে পড়ছে। তাছাড়া আরো অনেক উর্দুভাষী ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা বাংলা একদম জানতেন না। আমি বাংলা থেকে উর্দুতে তরজমা করে দিতাম এবং সালাউদ্দিন মোহাম্মদ সেগুলোর ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে দিতেন। পরে সেগুলো উর্দু দৈনিকে ছাপা হত।"

একথা স্পষ্টত যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন হয়েছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে, উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে নয়। তাই ৪৮ থেকে ৫২ পর্যন্ত  চার বছরে এই আন্দোলনে বহু সংখ্যক উর্দুভাষী কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-ছাত্র-পেশাজীবী ও সচেতন উর্দুভাষী নাগরিকরাও এই অন্দোলনে সমর্থনসহ অংশগ্রহণ করেছিলেন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমিনের কল্লা চাই’ স্লোগান তুলেছিলেন তারা। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার এই আন্দোলনের রক্তিম দিনকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমরা এই দিনে পৃথিবীর সকল মানুষের মাতৃভাষার প্রতি এবং সকল ভাষা সৈনিক ও শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।

লেখক: শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence