মুখ না দেখিয়ে ভাইভা: পরীক্ষা বোর্ডকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা কি অযৌক্তিক নয়?

ঢাবি বাংলা বিভাগ
ঢাবি বাংলা বিভাগ  © ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে ভাইভায় মুখ না দেখানো নিয়ে ঝামেলা প্রসঙ্গে। গতকাল থেকে এই নিউজটা ভাইরাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গ্রুপে এটা নিয়ে আলাপ হচ্ছে। অনেকে ইনবক্সে নিউজের লিংক দিয়ে জিজ্ঞেস করছেন। বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এই জায়গায় কিছু কথা বলার দরকার মনে করি নিজের থেকে। 

১। ভাইভায় যিনি মুখ দেখাতে চান নি তিনি বাংলা বিভাগ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। প্রশ্ন হচ্ছে সে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন জানে না যে যেকোনো ভর্তি এবং মৌখিক পরীক্ষায় মুখ এবং কান দেখা যাওয়া বাধ্যতামূলক?  যদি না জানেন তাহলে উনি এডমিশন কিভাবে দিলেন? ভর্তি পরীক্ষাতেও মুখ দেখাতে হয়। যেই ভাইভা বোর্ডে উনি বসছেন সেখানে তার এডমিট কার্ড ছিল। এডমিটের ছবির জন্য উনাকে মুখ খুলতে হয়নি? শিক্ষকদের কাছে সেই এডমিটের ছবি আছে, উনারা যদি সেই ছবি দেখেন, তাহলে তাদের সামনে মুখ খুলতে সমস্যা কোথায় এইক্ষেত্রে?
মনে করিয়ে দিতে চাই কয়েকদিন আগে জানা গেছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্র আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রই না। আর প্রক্সি এক্সামের ব্যাপার ও তো কম ঘটেনা, সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোরকম সতর্কতা এখানে অযৌক্তিক কিছু না।

২। অনেকেই বলছেন যে একজন ম্যাম ছিলেন, ছাত্রী ম্যামকে চেহারা দেখাতে রাজি হয়েছেন। উনি গায়ের মাহারাম কোনো পুরুষের সামনে মুখ খুলবেন না। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, ভাইভা বোর্ড কি একজন শিক্ষক নিয়ে হয় নাকি বাকি শিক্ষকদের ও সেখানে পার্টিসিপেশন থাকে? 
অভিযোগকারী ছাত্রী কি কখনো ক্লাসরুমে তার নিকাব করা নিয়ে কোনোরকম নেতিবাচকতার স্বীকার হয়েছেন? কোনো শিক্ষক মুখ ঢাকার জন্য তাকে কোনোরকম হেনস্থা করেছে? উত্তর হচ্ছে করেনি।
এবং এইদিন ও তাকে শুরুতে সুযোগ দেয়া হয়েছিল, এমনকি পরেরদিন আসতে বলা হয়েছে মুখ খুলে, সে আসেনি। 
অভিযোগকারী জুনিয়রের কাছে জিজ্ঞাসা হচ্ছে ভবিষ্যতে চাকরির পরীক্ষা, বিসিএসের জন্য ভাইভায় বসতে হয় উনি কি মুখ খুলবেন না?

হায়ার স্টাডিজের জন্য দেশের বাইরে যেতে চাইলে কি পাসপোর্ট ভিসা করতে মুখ খুলবেন না? 
পবিত্র হজ্ব পালন করতে যাওয়ার জন্য যখন ইমিগ্রেশনে চেহারা দেখাতে হবে সেরকম কন্ডিশনে উনি কি করবেন?
আর গায়েরে মাহরাম পুরুষের সামনে উনি যদি নিজের চেহারা না দেখান, তাহলে উনার জন্য তো একইভাবে কোনো পুরুষের চেহারা দেখাও হারাম। নিজের ক্ষেত্রে এই নিয়মটা না মেনে উনি কোএডুকেশনে আছেন। তারমানে প্রয়োজন মোতাবেক নিয়মের পরিবর্তনে উনি বিশ্বাসী। ভাইভা বোর্ডকে প্রয়োজনের বহির্ভূত মনে করাটা কি অযৌক্তিক নয়?

৩। যারা এই নিউজ গুলা খুব জোশের সাথে শেয়ার দিচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে একটা কথা বলতে চাই। ধর্ম এবং ধর্মীয় লেবাস বা যেকোনো কালচার খুবই সেন্সিটিভ ইস্যু। ইতর ক্লিকবেইট মিডিয়া খুবই চিজি হেডলাইন দিয়ে যে নিউজগুলো বের করে সেগুলো শেয়ার করে কোনো কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানকে গালিগালাজ করার আগে দুইবার ভেবে নিয়েন। পেছনের আসল ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা কইরেন।
এতো সহজেই যদি আপনাকে উষ্কে দেয়া যায়, তাহলে আপনার চিন্তার নিয়ন্ত্রণ নেয়া খুব সহজ। 
আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষকই সব ছাত্রদের চেনেন। পরীক্ষা, ভাইভাতে নিয়মিত খোঁজ নেন। ছাত্রের অসুস্থতায় দেখতেও গিয়েছেন এই বোর্ডেরই একজন শিক্ষক। 

আরও পড়ুন: পর্দার কারণে ভাইভায় মুখ দেখাতে না পেরে নম্বরবঞ্চিত হচ্ছেন ঢাবি ছাত্রী

গত সেমিস্টারের এক মিডটার্মের মধ্যে আমাদের খুবই মাতৃস্থানীয়া এক ম্যাম প্রচণ্ড গরমের ভেতরে আমার ক্লাসের একজনকে বলেছিলেন, সারাদিন মুখ ঢেকে থাকতে হয়, সুতির হিজাব নিকাব যেন ব্যবহার করে, তাহলে ওর কষ্ট কম হবে। সৌভাগ্যবশত আমি ওই রুমে ছিলাম। পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে পাশের রুমের আরেক ফ্রেন্ডের থেকে শুনি ম্যাম নাকি মুখ ঢাকা নিয়ে ওকে কথা শুনিয়েছেন। কে বলেছে, কিভাবে এসেছে কথাটা কেউ জানেনা, কিন্তু কথাটা স্বল্প পরিসরে হলেও ছড়িয়েছে। ওই রুমে না থাকলে হয়তো আমিও পুরো ঘটনা না জেনে বিশ্বাস করে যেতাম। হয়তো যাকে বলেছে সে নিজেও কাউকে বলেনি। এইযে এই ধরণের কথাবার্তার এরকম প্রচার এবং প্রসার, এর কারণটা কি? 
কারণ হচ্ছে এটা একটা ধর্মের সাথে যুক্ত। খুব সহজেই
ম্যানিপুলেট করা যায়, মানুষকে বিভক্ত করা যায়।

এতোগুলা কথা লেখার কারণ আমার বিভাগ আর আমার শিক্ষকদের যে নোংরা ভাষায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রুপে আর নিউজে আক্রমণ করা হচ্ছে এটা মেনে নেয়া প্রচণ্ড কঠিন। এমনকি আজকে আমাকেও একজন আক্রমণ করে কথা বলেছে।

এই বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষ থেকে হিজাব পরে আমি কোনোদিনই শিক্ষকদের কাছে কোনোরকম জটিলতার সম্মুখীন হইনি। বিভাগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছি হিজাবেই। আমার ক্লাসের অনেক মেয়ে মুখ ঢেকে থাকে, ক্লাসে বা টিউটোরিয়ালে কখনোই তাদের এই নিয়ে কোনো শিক্ষক কোনোভাবে হেনস্থা করেন নি। পোশাক বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা এই জায়গাটায় ছিল, আছে এবং সবসময়ই থাকবে।

আমার খুবই লজ্জা লাগে যখন দেখি আমারই জুনিয়র একটা ব্যাচ থেকে এরকম একটা ঘটনা এভাবে ছড়ায় আর পুরো ব্যাচের মৌন সমর্থন ও থাকে এরকম কথাবার্তার প্রতি। এরা পরের সেমিস্টারগুলোতে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী যখন পড়বে, কি রিএকশন হবে এদের? মহাভারত, ভারতীয় পুরান, ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত পড়তে গেলে পারস্য সংস্কৃতির ওপর আরবের আধিপত্য- কুফুরিয়া, সমাজ নৃতাত্ত্বিক সাহিত্য গবেষণা, জাতি- ধর্ম- সংস্কৃতি ভাবনা এগুলো এরা কিভাবে নেবে? আর যারা এতো সঙ্কীর্ণ চিন্তা করে তারা বাংলা সাহিত্য পড়তেই বা চায় কেন?

গত তিন চারদিন হল নিউজ দেখছি যে কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ফ্রয়েড পড়ানোর জন্য শিক্ষককে  লান্চছিত করেছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্বাস হতে চায়নি, কিন্তু ঘটনা সত্য। এই দেশে বোধহয় এরকম দিনকাল ই আসছে সামনে। জানিনা!

বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপগুলো একেকটা র‍্যাডিক্যাল মানসিকতার আখড়া, তারা বিভিন্নভাবে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে যে বাংলা বিভাগে নিয়মিত ইসলামোফোবিয়ার চর্চা হয়, এরকম ঘটনা ঘটে। এমনকি নিউজের লিংক গুলাতেও মানুষ বিভাগ তুলে আজেবাজে কথা বলছে। 

বাংলা বিভাগে এগুলোর কোনোটাই হয় না। বাংলা বিভাগের উদারতা ধারণ করার সামর্থ্য মাথায় শুধুমাত্র ধর্মীয় উগ্রবাদ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষদের ছিল না আগেও। ভবিষ্যতেও থাকবে না।
এবং এতে বাংলা বিভাগের কিচ্ছু যায় আসেনা। তাদের সিদ্ধান্তের সাথে একাত্মতা পোষণ করি।

লেখক: মাহফুজা মাহবুব নৌশীন

শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence