বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে শিক্ষক-সরকারি কর্মকর্তাদের হয়রানি
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৪১ AM , আপডেট: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০৯:১৩ AM
ছাত্র-জনতার প্রবল গণআন্দোলনের মুখে অবসান হয়েছে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামল। গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলন করতে নেমে শেষ পর্যন্ত সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবি বাস্তবায়ন করতে প্রাণ হারায় বহু ছাত্র-জনতা। এ গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামের ছাত্র সংগঠনটির নাম ভাঙিয়ে দেশের নানা স্থানে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-প্রধানদের হেনস্তা, অপমান অপদস্ত করার অভিযোগ উঠেছে।
এমন পরিস্থিতিতে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে পারছেন না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও স্থবির হয়ে যাচ্ছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্লাটফর্ম একটি সফল গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাদের অর্জিত এ সাফল্যকে ধরে রাখতে হলে সমন্বয়কদের আরো সজাগ থাকাতে হবে, যেন অতি উৎসাহী হয়ে কোন অছাত্র তাদের অর্জনকে ম্লান করতে না পারে; এমন মত তাদের।
বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে একদল কিশোর ও যুবক গিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচয়েয় প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষকে অপসারণের দাবি জানান বলে অভিযোগ প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের। প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কিছু বহিরাগত ছাত্র স্কুলের শিক্ষকদের জোর করে মিটিং করতে বাধ্য করেন। এ মিটিং থেকে অধ্যক্ষের পদত্যাগের পক্ষে শিক্ষকদের কাছ থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। বিষয়টি ঢাবির প্রক্টরকে জানানো হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হালিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, স্কুল-কলেজে পড়া কিছু ছেলে এসে অধ্যক্ষকে পদত্যাগের দাবি জানান। তাদের সঙ্গে আমাদের স্কুলের কিছু শিক্ষার্থী যোগ দেন। তারা শিক্ষকদের মিটিং করতে বাধ্য করেন। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পদত্যাগ বা অপসারণের দাবিতে স্কুল বা কলেজে যেন অপ্রীতিকর ঘটনা না হয়, তা তদারকি করতে ডিসিদের বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, যারা আন্দোলন করতে এসেছিলেন তাদের একজন এ স্কুলের সাবেক ছাত্র, যিনি টিসি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনিসহ প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষার্থী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করেন। যদিও ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান স্যার ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বস্ত করেছে। তারপরও একজন শিক্ষককে নিয়ে টানাহেঁচড়া কারো কাম্য নয়।
আরও পড়ুন : ট্রাস্টি হিসেবে এসে বিশ্ববিদ্যালয় দখল আইবিএ পরিচালক ড. ইউসুফের
জানতে চাইলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজে বৃহস্পতিবার কোন দাবি-দাওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের কেউ জাননি।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে কুড়িগ্রামে যাত্রাপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আফজাল হোসেনের পদত্যাগ দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ হয়। কিন্তু বিক্ষোভ আয়োজন করা কেউই ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলে জানান কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা শিপন সরকার।
তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, স্থানীয়রা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু করলে আমাদের কাছে খবর আসে। আমরা গিয়ে দেখি, তারা ছাত্র আন্দোলনের ব্যানার ব্যবহার করে আন্দোলন করছেন। পরে তাদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আপত্তি জানানো হলে তারা এলাকাবাসী লেখা ব্যানার নিয়ে এসে আন্দোলন করেন। স্থানীয়রা তাদের দাবি-দাওয়া জানাতে পারেন, তবে ছাত্রদের ব্যানার ব্যবহার কাম্য নয়।
আরও পড়ুন : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কমিটি বাতিল
গত মঙ্গলবার নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে উপজেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাঈদ মোহাম্মদ জসিমকে সাকিবুল হাসানকে হেনস্তা করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। আবু সাঈদ মোহাম্মদ জসিমের অভিযোগ, তারা তাকে হুমকি দেয় ও অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
এরপর বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে লোহাগড়ার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানান, উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলীকে হেনস্তা করায় তাদের হাত নেই। তারা বলেন, যেকোনো ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড কেউ অন্যায়ভাবে করতে গেলে লোহাগড়া উপজেলার সাধারণ শিক্ষার্থীরা তার দায়ভার বহন করবে না। প্রশাসনের প্রতি বিনীত অনুরোধ আপনারা অন্যায় কিছু দেখলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নেবেন।
অপরদিকে সাতক্ষীরা সদরেও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ জেলা শহর ও এর বাইরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অফিসে গিয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচারণ করছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। অফিসের দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা বলে কর্মকর্তাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। যে কারণে চরমভাবে বিরক্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন : বন্যায় প্রায় ১১ হাজার মানুষকে চিকিৎসা দিয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন
সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক মেহেদী হাসানের অভিযোগ, গত ১১ আগস্ট থেকে বেশ কয়েকজন ছাত্র পাসপোর্ট অফিসে এসে বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। অফিসে এসে তারা আমার সঙ্গে দেখা না করেই পাসপোর্ট করতে আসা বিভিন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলাসহ তাদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে জানার চেষ্টা করেন। এসব বিষয় জেনে তারা নিজেরা স্যাটিসফাইড হয়ে চলে যান।
তাদের এ কর্মকাণ্ডকে স্বাগত জানানো হয়। কিন্তু গত ১৩ আগস্ট বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ছাত্র পরিচয় বেশ কয়েকজন তার অফিসে এসে তার অফিস সহকারী রিগানকে জোর করে ধরে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারা কেউ ছাত্র ছিল না। সেখান থেকে খবর পেয়ে পরে প্রকৌশলী নিজে সেনা ক্যাম্পে গিয়ে অফিস সহকারীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অতীশ সরকারকেও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে হয়রানী করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাতক্ষীরার সমন্বয়ক মো. নাজমুল হোসেন রনি বলেন, আমার কানেও এরকম কিছু খবর এসেছে যে, ছাত্র পরিচয়ে বেশ কয়েকজন সাতক্ষীরা সদর ভূমি অফিস ও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসসহ বেশ কয়েক জায়গায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করেছে। এসব যারা করছে তাদের সাথে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের কোন সম্পর্ক নেই। পুনরায় এমনটি কোথাও হলে তাদেরকে ধরে সেনা ক্যাম্পে অথবা নিকটস্থ থানায় হস্তান্তর করার জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ করা হলো।
কুড়িগ্রামে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে ভুয়া সমন্বয়কদের বিষয়ে অবহিত করা ও সন্ত্রাস, লুটপাট এবং সহিংসতা বন্ধের জন্য গত ৮ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনকারীরা। তারা বলেন, যারা ভুয়া সমন্বয়ক হিসেবে নিজেদের পক্ষে অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের অপপ্রচার বন্ধ করার জন্য আহবান করছি। কোনো ধরণের ভুয়া সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া থেকে তাদের বিরত থাকার অনুরোধ করছি।
আরো পড়ুন: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কমিটি বাতিল
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে দেওয়া এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে আমার মিথ্যা স্বাক্ষর ব্যবহার করে নোটিশ পাঠানো এবং সাধারণ জনগণকে হয়রানির অভিযোগ আসছে। এমনকি স্কলারশিপে জাপানগামী একজন ব্যক্তিকে আমার স্বাক্ষর ব্যবহার করে ইমিগ্রেশনে আটকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এসব অভিযোগের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের মানুষের কাছ থেকে এমন কার্যকলাপ হতাশাজনক। স্বাক্ষর জালিয়াতি বাংলাদেশের আইনে একটি ফৌজদারি অপরাধ। আমাদের স্বাক্ষর ব্যবহার করে কেউ এমন প্রতারণা করলে দেশের আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
হাসনাত আরও বলেন, আমাদের গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিটের পরিপন্থী হওয়ায় তদবির, মিথ্যা মামলা, হয়রানি ও চাঁদাবাজি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইনি কাঠামোর আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। আমাদের কোনো সিস্টেম-বিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পর্ক নেই।