আ’লীগের কার্যালয়ে বিএনপির ব্যানার, নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ‘চাঁদাবাজি ও দখল’

ঢাকার মোহাম্মদপুরে আওয়ামী লীগের কার্যালয় বিএনপির সংগঠনের দখলে
ঢাকার মোহাম্মদপুরে আওয়ামী লীগের কার্যালয় বিএনপির সংগঠনের দখলে  © বিবিসি বাংলা

সাভারের হেমায়েতপুরে মূল সড়ক থেকে একটু ভেতরে জয়না বাড়ি রোড। স্থানীয় এক বাজারে গিয়ে চাঁদাবাজির তথ্য পাওয়া গেল। দোকানিরা বলছেন, আগে আওয়ামী লীগের লোকজন চাঁদা তুললেও এখন এর নিয়ন্ত্রণ ‘অন্য গ্রুপের’ হাতে। দোকানপ্রতি তোলা হচ্ছে ২০০ টাকা করে।

এক দোকানি বলছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন নাই। এরপরও দুইদিন চাঁদা দিলাম। আইসা কয় টাকা মাফ নাই। হ্যারা নাকি টাকা তুইল্যা অন্য গ্রুপের কাছে দিতাছে।’ অন্য গ্রুপ মানে কী এমন প্রশ্নে অবশ্য খোলাসা করে কিছু বলেননি তিনি। তার ভাষ্য, ‘আগে যে ম্যানেজার কালেকশন করতো, সে ছিল আওয়ামী লীগের। ওই ম্যানেজারই কালেকশন করতাছে। এখন কারে দেয়, সে প্রশ্ন আর করি নাই।’

আরেকজন দোকানি জানালেন, আগের মতোই তিনি ২০০ টাকা করে চাঁদা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি একদিন দিছি ২০০ টাকা। পরের দিন দোকান খুলি নাই। আজকে খুলছি, টাকা দেয়া লাগবে।’

বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়েছে, দেশে সরকার পরিবর্তনের পর ব্যক্তির বদল ঘটলেও দুর্নীতি, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি বা দখলের পুরোনো ব্যবস্থার পরিবর্তন খুব একটা হয় না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও কমবেশি একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। চাঁদাবাজি, প্রভাব খাটানো এমনকি দখলের মতো অভিযোগ উঠছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। যদিও অন্তবর্তীকালীন সরকার তো বটেই, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে এ ধরনের ঘটনায় কোনো ছাড় না দেয়ার কথা। এতে কি চাঁদাবাজি আর দখল বন্ধ হয়েছে? বাস্তবতা অবশ্য সে কথা বলছে না।

সাভারের হেমায়েতপুরে সব স্থানে যে চাঁদাবাজি হচ্ছে এমন নয়। মূল সড়ক এবং সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ড, টেম্পু স্ট্যান্ড ও দোকানগুলোতে কেউ চাদা চাইতে আসছে না বলে জানাচ্ছেন দোকানদাররা। ইমরান আলী নামে এক দোকানি বলছেন, আগে চাঁদাবাজি হলেও এখন আর কেউ আসছে না। এখনতো সবখানে ছাত্র। সবাই বলে গেছে, কেউ চাঁদা নিতে আসলে ফোন করে জানাতে। মাইকিংও হয়েছে। ফলে এখনও আমরা শান্তিতে আছি।

হেমায়েতপুরের একটু ভেতরে গেলে চাঁদাবাজির চিত্র স্পষ্ট হয়। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, জয়নাবাড়ি, যাদুরচর, শ্যামপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজির ঘটনা চলছে। কিন্তু কারা করছে এসব এমন প্রশ্নে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে রাজি হলেন না। তবে গোপনীয়তা রক্ষার শর্তে স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, এসব চাঁদার পেছনে আছে তাদের ভাষায় ‘বিএনপির লোকজন’।

রমিজ উদ্দিন (ছদ্মনাম) নামে একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের লোকজন দোকান, রিক্সা স্ট্যান্ড থেকে চাঁদা তুলতো। মূলত সরকারি জায়গায় যেসব দোকান আছে সেগুলো থেকে ভাড়ার নামে চাঁদা তোলা হয়। এগুলো সব আওয়ামী লীগের ব্যানারে হয়েছে। পট পরিবর্তনের পরে এখন বিএনপির সাইনবোর্ড লাগায়ে আবার শুরু করছে। তাদের পেছনে আছে বিএনপির লোকজন।

চাঁদাবাজির একই অভিযোগ আছে ঢাকার ভেতরেও।বুধবার ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে গিয়ে দেখা যায় দখলের দৃশ্য। বাবর রোডে বিহারি ক্যাম্পের কাছেই রাস্তা এবং ফুটপাতের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছিলো শ্রমিক লীগের কার্যালয়। সে কার্যালয়ের দখল নিয়েছে মোহাম্মদপুর থানা যুবদল। কার্যালয়টি তালাবদ্ধ থাকলেও যুবদলের একটি ব্যানার ঝুলছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, যুবদলের নেতা-কর্মীরা কার্যালয় দখল করলেও সেখানে কেউ বসছে না। স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, ‘শেখ হাসিনা পালাইবার পরে এখানে এখন বিএনপি দখল করছে। কিন্তু ওরা শুধু ব্যানার লাগাইছে, বসে না। যখন ক্ষমতায় আসবে তখন বসবে।’

একই অবস্থা পশ্চিম আগারগাঁও এলাকাতেও। সেখানে কালভার্টের ওপর গড়ে তোলা আওয়ামী লীগের কার্যলয় এখন বিএনপির। সরেজমিন দেখা যায়, নতুন টিন লাগিয়ে কার্যালয় মেরামত করা হয়েছে। কার্যালয়ের গায়ে সাঁটানো হয়েছে ছাত্রদলের দুর্নীতিবিরোধী পোস্টার। তবে কার্যালয়টি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার পতনের পর ৫ অগাস্ট রাতে কার্যারয়টি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। পরের দিন মেরামত করে নিজেদের দখলে নেয়। ঢাকা শহরে সবখানেই যে চাঁদা তোলা হচ্ছে এমন নয়। ঢাকার পাঁচটি স্পটে ঘুরে খোঁজখবর নিয়ে দেখা যায়, চারটি স্পটেই চাঁদাবাজির কোনো ঘটনা নেই। মূলত ফুটপাতের হকার, রাস্তার পাশের দোকান, পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে চাঁদাবাজির তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে মৎস ভবন এলাকায় কয়েকজন টং দোকানি জানিয়েছেন, তাদের কাছে চাঁদা চাওয়া হয়েছে।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানদার বলছিলেন, কয়েকদিনে দুটি গ্রুপ এসে চাঁদা দিতে হবে বলে জানিয়ে গেছে। একজন আইসা বইলা গ্যাছে, চাঁদা দেওয়া লাগবো। পরে আবার বিকালে আরেক গ্রুপ আইছে। বলছে ট্যাকা এখন থেইকা আমরা উঠামু, অন্য কাউরে দিবা না। আমি পরে কইছি, আপনারা আগে মিটিং কইরা ঠিক করেন কারে দিমু।

এর বাইরে বিভিন্ন এলাকায় আছে মার্কেটের দোকান দখল এবং গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসার হস্তান্তর চেয়ে হুমকি দেয়ার ঘটনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৈরি পোশাক কারখানার একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের কারখানায় বিএনপির পরিচয়ে এসে ঝুটের ব্যবসা হস্তান্তরের জন্য হুমকি দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ঝুটের ব্যবসা এখন আমরা করবো। অন্য কাউকে দিবেন না। কারখানায় এসে এইরকম কথা বলে গেছে। হুমকি দিয়ে গেছে। ১০/১২টা মোটরসাইকেল নিয়ে কারখানায় ঢুকে। বলে যে বিএনপির অমুক নেতা পাঠিয়েছে।’

৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে যে পালাবদল ঘটে তার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি এবং দখলের খবর উঠে আসে গণমাধ্যমগুলোতে। মূলত আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আসার পরপরই দলটির পক্ষ থেকে কিছু ব্যবস্থাও নেয়া হয়। সরকার পতনের রাতেই বরিশাল শহরে পুকুর ভরাট করে দখলের অভিযোগ ওঠে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরীনের বিরুদ্ধে।

গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলে গত ১১ অগাস্ট বিলকিস জাহান শিরীনের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়। যদিও দলীয় প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি।

বরিশালের মতোই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকলে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে দখল কিংবা আধিপত্য বিস্তারসহ যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়।

আরো পড়ুন: জেলের ছদ্মবেশে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে পুলিশে দিলেন জনতা

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে দলের নেতাকর্মীরা এমন কর্মকাণ্ডে কেন জড়িয়ে পড়লেন? বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, যতটা প্রচার হচ্ছে, বাস্তবে ততটা ঘটছে না। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি বলব না যে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটেনি। হয়তো ঘটেছে। কোথাও যদি কোনো আওয়ামী লীগের অফিস দখল করে নেয়া হয়ে থাকে, এটা দখলের প্রবৃত্তি থেকে আসেনি। এটা এসেছে মানুষের প্রতিবাদের প্রবৃত্তি থেকে। তবে আমাদের কাজ হলো সেটাকে নিবৃত্ত করা।’

বিএনপি জানাচ্ছে, দলের সব স্তরে তাদের ভাষায় ‘যে কোন অপকর্ম’ থেকে বিরত থাকতে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এরপরও এসব ঘটনা থেমে নেই। এমন প্রেক্ষাপটে কয়েকদিন আগেই সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন চাঁদাবাজ ও দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

এর মধ্যেই থানাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম শুরুর প্রেক্ষাপটে তিনি জানিয়েছেন, এরকম কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, ‘আমরা অলরেডি ওয়ার্নিং দিয়েছি। যদি এতে কাজ না হয়, তাহলে পুলিশই দেখবে এটা।’

বাংলাদেশে কোনো একটি সরকার পরিবর্তনের পর ব্যক্তির বদল ঘটলেও দুর্নীতি, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি কিংবা দখলের যে পুরনো ব্যবস্থা, সেটির পরিবর্তন খুব একটা হয় না। এবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘সিস্টেম বদলে দেয়া’র কথা। এ বিষয়ে সরকারের উপর ছাত্র-জনতারও চাপ আছে। কিন্তু বাস্তবে কতটা কী হবে সেটাই দেখার বিষয়।


সর্বশেষ সংবাদ