নতুন শিক্ষাক্রম

থাকবে না জিপিএ-৫, গুরুত্ব বাড়বে মার্কশিটের

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)  © ফাইল ছবি

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্দেশ্যে চলতি বছর নতুন শিক্ষাক্রম চালু করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ইতোমধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের তিনটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। বাকি  শ্রেণিগুলোতে ২০২৬ সালের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৮ সালের মধ্যে সব পরীক্ষা পুরোপুরি নতুন পদ্ধতি অনুযায়ী হবে। ২০২৮ সালের মধ্যে গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ বা জিপিএ ভিত্তিক ফলাফলও উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে। যেখানে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে সার্টিফিকেটের চেয়ে মার্কশিটকে গুরুত্ব দেয়ার কথা ভাবছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। 

২০২৪ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার বিভাগ বিভাজনও থাকছে না। এ সময় সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়তে হবে। ফলে নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি চালু হলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে একই বিষয় পড়ানো হবে। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন পুরানো নিয়মেই থাকছে। 

নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম মোট তিনটি শ্রেণিতে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৬ সালে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে এসএসসি এবং ২০২৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষা হবে। শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল নির্ণয়েও পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

২০২৬ সালে মাধ্যমিক ও ২০২৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে রাখা হচ্ছে না গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ বা জিপিএ ভিত্তিক ফলাফল। তবে এখনও এনসিটিবির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে নতুন ফলাফল পদ্ধতি ঠিক করা না হলেও ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন ফলাফল পদ্ধতি নির্ণয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। 

চলতি বছর থেকে শুরু হওয়া নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে পড়ানোর ধরন, মূল্যায়ন ও পাঠ্যবইয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত মূল্যায়নে  পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসির পরিবর্তে শুধু এসএসসি পরীক্ষা রাখা হয়েছে।  আর উচ্চ মাধ্যমিকের চূড়ান্ত মূল্যায়নে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আলাদা পরীক্ষা হবে এবং এর ফলাফল হবে উভয় শিক্ষাবর্ষ বিবেচনায়। বোর্ড পরীক্ষার সাথে শিখনকালীন মূল্যায়নও যুক্ত হবে।

তবে সব শ্রেণিতেই বড় অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীনের ভিত্তিতে। এজন্য শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের রেকর্ড সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন সামষ্টিক মূল্যায়নে বেশি ভালো থেকে কম ভালো নির্ণয়ে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্ত নামে শিক্ষার্থীদের অবস্থান দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রথাগত পরীক্ষা কমে যাচ্ছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে— ২০২৬ সালে মাধ্যমিক ও ২০২৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে রাখা হচ্ছে না গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ বা জিপিএ ভিত্তিক ফলাফল। এই সময় থেকে শুধু এসএসসি ও এইচএসসিতে চূড়ান্ত মূল্যায়ন পরীক্ষা হবে। সার্টিফিকেটের চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে মার্কসীট। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীতে সামষ্টিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মূল্যায়িত হচ্ছে। দশম শ্রেণী পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীদের জন্য অভিন্ন ১০টি বই রাখা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত থাকছে না কোনো ধরনের পরীক্ষা।

জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো পরীক্ষা দিতে হবে না। তাদের শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিকের ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ ভাগ। বাকি ৪০ ভাগ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। আর এ শ্রেণিগুলোতে বাকি বিষয়গুলোতে প্রাথমিকের মতো রাখা হয়েছে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন। 

Class-teacher-image

নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগে শিখনকালীন মূল্যায়ন হিসেবে রাখা হয়েছে ৫০ ভাগ। বাকি ৫০ ভাগ সামষ্টিক মূল্যায়ন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। পাশাপাশি অন্য বিষয়গুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন শতভাগ করা হয়েছে। দশম শ্রেণি শেষে ওই শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।

একইভাবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আবশ্যিক বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ ভাগ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ ভাগ করা হয়েছে। নৈর্বাচনিক ও বিশেষায়িত বিষয়ে সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক, ব্যবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। এছাড়া একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর প্রতি বর্ষ শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে।

২০১৯ সালে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা, বাস্তবায়নের বাস্তব অবস্থা যাচাই ও চাহিদা নিরূপণ সমীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন এই শিক্ষাক্রম চালুর সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমও পর্যালোচনা করা হয় এনসিটিবির ওই সমীক্ষায়।

তবে বিভাগ বিভাজন বন্ধ ছাড়াও নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে এখনও সঠিক ধারণা নেয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। নতুন শিক্ষাবর্ষের আর মাত্র কয়েকমাস বাকি থাকলেও এ নিয়ে অংশীজনের কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়নি। হয়নি কোনো কর্মশালাও। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

এনসিটিবির সমীক্ষা প্রতিবেদনে বিগত শিক্ষাক্রম বিবেচনায় বলা হয়েছে, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু তাদের কার্যকর সমন্বয়ের অভাবে অনেক সময় চাহিদা অনুযায়ী নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে অবশ্যই উদ্ভাবনী ও কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ জরুরি।

আরও পড়ুন: অক্টোবরে প্রশিক্ষণ পাবেন ‘বাদ পড়া’ ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষক

নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যে বিভাজন হবে উচ্চমাধ্যমিক থেকে। আর মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন তুলে দেওয়া হলে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি বিষয় পড়তে হবে শিক্ষার্থীদের।

নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার, এনসিটিবি যে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করবে তা বাস্তবায়ন করার কথা জানান।

tdc_teac

শিক্ষাক্রমের সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি  নতুন শিক্ষাক্রম সব শ্রেণিতে চালুর বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য মডিউল তৈরি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও নতুন পাঠ্যবই রচনা এবং মুদ্রণ একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। ধাপে ধাপে নতুন শিক্ষাক্রম কার্যকর করা হলে ভুলত্রুটি শুধরে সামনে এগোনো যায়। নতুন শিক্ষাক্রমের সামষ্টিক মূল্যায়নে যেভাবে দেওয়া হচ্ছে, তা আসলে এক্সপেরিমেন্ট। শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত মূল্যায়ন কীভাবে করা হবে, তা ২০২৫ সালে নির্ধারিত হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে অধ্যাপক মশিউজ্জামান আরও বলেন, উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই তিন দশক আগে থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ বা গ্রেডিং নেয়। তাই শিক্ষার্থীদের মেধা, যোগ্যতা ও সমতার কথা চিন্তা করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। 

তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তটি যুগান্তকারী আখ্যা দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, দশম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো বিভাজন না রাখাটাও অনেক সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত। পৃথিবীর অনেক দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের দিতে হয় না। এতদিন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরিত ছিলো বিধায় জ্ঞান সাধনায় শিক্ষার্থীদের মনোনিবেশ কম ছিল। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ভূমিকার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের আওতায় আনার পরামর্শ তার। 

দেশের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, এখন ফল মূল্যায়ন করা হয় সব নম্বরকে গড় করে বা জিপিএ‘র ভিত্তিতে। এতে একজন শিক্ষার্থী এক বিষয়ে কম পেয়েও অন্য বিষয়ে বেশি নম্বর পেয়ে গড়ে ভালো ফল করছে। কিন্তু অন্যান্য দেশে শুধু আলাদা গ্রেড পয়েন্টকে মূল্যায়ন করা হয়। তাই এ বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে পাবলিক পরীক্ষায় গ্রেড পদ্ধতি চালু হয়। যেখানে গ্রেড পয়েন্ট ৫ (লেটার গ্রেড এ প্লাস) কে সবোর্চ্চ ধরা হয়। তবে ২০০১ সালের আগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ চালু ছিল। এর আগে ও পরে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে একটি করে বোর্ড পরীক্ষা চালু ছিল।

পরবর্তীতে ২০০৯ সালে শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন এনে প্রাথমিকের ৫ম শ্রেণিতে পিএসসি এবং মাধ্যমিকের ৮ম শ্রেণিতে জেএসসি নামে বোর্ড পরীক্ষা চালু করা হয়। তবে পুরো শিক্ষাক্রম ঢালাওভাবে পরিবর্তন করার পদক্ষেপ এবারই প্রথম।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence