প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?
- হোসনে সাদিয়া নিতু
- প্রকাশ: ২২ জুন ২০২০, ০৮:৩৪ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৩৭ AM
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে আট লক্ষেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে নিজের জীবন শেষ করার পথ বেছে নিচ্ছে। এর অর্থ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথ আকুল হয়ে বলেছিলেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’। অথচ এই সুন্দর ভুবন ছেড়ে চলে যেতে অনেকেই করেন তাড়াহুড়া, করেন আত্মহত্যা। কিন্তু কেন করেন?
আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ আসলে কী? একদিনেই কি মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় সে আত্মহত্যা করবে? মূলত জীবনে কঠিন কঠিন চলার সময় ছোট ছোট ঘটনাগুলো এক সময় পরিণত হয় মানসিক দুশ্চিন্তায়। আর সে কঠিন সময়কে পার করতে না পেরেই মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহত্যার মত কঠিন সিদ্ধান্তের।
আত্নহত্যা কি?
আত্মহত্যা বা আত্মহনন (ইংরেজি: Suicide) হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ। ল্যাটিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ আত্মহত্যা করেন, তখন জনগণ এ প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করে। ডাক্তার বা চিকিৎসকগণ আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
ব্রিটিশ কবি থমাস শ্যাটারটন আত্মহত্যা করেছিলেন এই বলে যে ‘আমার মতো কোমল হৃদয়ের জন্য এই নির্মম পৃথিবী যোগ্য নয়।’
মানসিক অশান্তি, পারিবারিক বিপর্যয়, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি নানান বিষয় থেকে ঘটছে আত্মহত্যার মতো ধ্বংসাত্মক ঘটনা।
ইসলাম কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না। ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মেও আত্মহত্যা মহাপাপ। শেষ আসমানী গ্রন্থ আল-কুরআনের সুরা নিসায় একটি আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়ালু। আর যে বাড়াবাড়ি ও জুলুমের কাজ করবে, তাকে আমি আগুণে পোড়াবো। একাজ আল্লাহর পক্ষে সহজ।”
কোনো কোনো ইসলামী পন্ডিত মনে করেন, আয়াতটি আত্মহত্যার বিরুদ্ধেই নাজেল হয়েছে। আর ইসলামের শেষ নবী তো আত্মহত্যাকে সরাসরিই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
আত্মহত্যার ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষ পান করে আত্মহত্যা করে, সে-ও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে নিজ হাতে বিষ পান করতে থাকবে। আর যেকোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করে, তার কাছে জাহান্নামে সেই ধারালো অস্ত্র থাকবে, যা দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেট ফুঁড়তে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
এমন কোন অপরাধের কথা আপনি জানেন কি? যা করলে শাস্তি হয় না, কিন্তু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে শাস্তি হয়?
এই সরল ধাঁধাঁর উত্তর হচ্ছে ‘আত্মহত্যা’। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মহত্যা মহাপাপ। আইন অনুসারে এটি একটি অপরাধ। দন্ডবিধির ৩০৯ ধারায় বলা আছে- যদি কোন লোক আত্নহত্যা করার চেষ্টা করে এবং অনুরুপ অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করে, তবে উক্ত লোক এক বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
যাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি রয়েছে
১। সিজোফ্রেনিয়া, ডিপ্রেশন বা কোন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির আত্মহত্যার ঝুঁকি রয়েছে।
২। কাছের কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের অন্য কেউ আত্মহত্যা করে থাকলে।
৩। পারিবারিক বা অন্য কোনভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হলে।
৪। কোনো বড় ধরণের শারীরিক অসুস্থতা থাকলে।
৫। ভালোবাসার সম্পর্কের অবনতি হলে।
৬। মাদকে আসক্ত বা অ্যালকোহলে আসক্ত ব্যক্তি।
৭। কোনো প্রকার বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলে।
৮। ইতোমধ্যেই এক বা একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে যেসব তরুণ-তরুণীরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ৫ জন আত্নহত্যা তরুণদের মাঝে ৪ জনই আত্নহত্যা করার পূর্বে ইঙ্গিত প্রদান করে। আমরা শুধু সেগুলোতে লক্ষ্য রাখবো।
-খুব বেশি মরার কথা বলা।
-আত্নহত্যার বিভিন্ন উপায় নিয়ে কথা বলা।
-নিজের অসহায়ত্ব, কষ্ট, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা নিয়ে কথা বলা।
-অন্যের উপর নিজেকে বোঝা মনে করা।
-যেমন ইচ্ছে তেমন ব্যবহার করা।
-অতিরিক্ত বা খুব কম ঘুমানো।
-সাধারণ জীবন থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
-খুব ঘন ঘন বা অকারণে মেজাজ বদলে যাওয়া।
-অতিরিক্ত রাগ বা প্রতিশোধের মনোভাব থাকা।
আত্নহত্যা প্রতিরোধে করনীয়
১। দেরি না করে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞর শরণাপন্ন হন, যদি কখনো (একবারের জন্য হলেও) আত্মহত্যা করার চিন্তা করে থাকেন। ডাক্তারের সাথে মন খুলে কথা বলুন, পরামর্শ নিন।
২। আপনার পরিবারের কেউ কিংবা কোন বন্ধু-বান্ধবী আত্মহত্যার কথা শেয়ার করলে বা হুমকি দিলে তা কখনোই হালকা ভাবে নিবেন না। যত তারাতারি সম্ভব তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করুন। দ্রুত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন এবং তার সাথে কথা বলুন।
৩। ধর্মীয় অনুশাসনগুলো মেনে চলতে আগ্রহী হন। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো আরো শক্তিশালী করে তুলুন।
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে আত্মহত্যাকে মানসিক অসুস্থতাসংক্রান্ত বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এ ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভবপর। যখন একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার বিষয়ে ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন, তখনই তাকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
মনোবিদগণ বলেন যে, যখন ব্যক্তি নিজেকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে তা জানামাত্রই সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে কাউকে জানানো। ভুক্তভোগী ব্যক্তি ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে কিভাবে আত্মহত্যা করবেন, তা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।এক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ এর কথা বলেন মনোবিজ্ঞানীগন।
স্ক্রিনিং
আত্মহত্যার চূড়ান্ত হারে সাধারণ জনসংখ্যার স্ক্রীনিংয়ের প্রভাবগুলির উপর সামান্য তথ্য রয়েছে। আত্মঘাতী ধারণা এবং আত্মঘাতী অভিপ্রায় থেকে আহতদের মধ্যে যারা জরুরী বিভাগে আসে তাদের স্ক্রীনিং শনাক্ত করার মাধ্যমে সাহায্য করা যায় ।
মানসিক অসুখ
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে যেসব চিকিৎসা দেয়া হয় তা আত্মহত্যার ঝুঁকি কমাতে পারে। যারা সক্রিয়ভাবে আত্মঘাতী হয় তারা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মনস্তাত্ত্বিক যত্নে ভর্তি হতে পারে।
মনোবিজ্ঞানী ডায়ান বার্থ বলছেন, যদি বন্ধু, সঙ্গী, আত্মীয়স্বজন কেউ না থাকে অথবা তেমন কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে না চান কেউ, তাহলে অন্ততপক্ষে যেন সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইন কমিউনিটিগুলির সঙ্গে যুক্ত থাকেন একা মানুষেরা। এতে মানসিক চাপ কমবে অনেকটা।
যে যেভাবে পারেন নিজেকে ভালো রাখেন। অন্য মানুষ কি বলে সেটা কানে নিবেন না। ডিপ্রেশন খুব খারাপ। এর সাথে লড়াই করুন এবং যারা ডিপ্রেশন বুঝেন না তারা দয়া করে নিজের মুখ বন্ধ রাখেন। মনে রাখবেন আপনার একটা জাজমেন্ট, আপনার একটা নেগেটিভ কমেন্ট, আপনার একটা পাত্তা না দেওয়ার ভাব একজন মানুষকে আত্মহত্যা করার দিকে উৎসাহিত করতে পারে। ইতিবাচক ও বন্ধুসুলভ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারলে তরুণ প্রজন্মের এই আত্নহত্যা প্রবণতা কমানো সম্ভব!
নিজে হাসুন, বন্ধুকে হাসান, বাঁচুন আপনি, বাঁচান মানুষকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়