কাশ্মীরের পরাধীনতা এবং একজন হরি সিং

সেনাবাহিনীর
সেনাবাহিনীর   © সংগৃহীত

সাত লক্ষ সেনাবাহিনী দিয়ে অবরূদ্ধ এক জনপদের নাম কাশ্মীর। কাশ্মীরকে আমার দু'চোখ দেখেনি কিন্ত আমার দু'চোখ কাশ্মীর কে নিয়ে কালো অক্ষরে লেখা বর্ণনা পড়েছে। একটা শান্তিপ্রিয় জাতির দূর্ভাগ্যের কথা পড়েছে। দু-দিক থেকে কাশ্মীরকে গিলে খাচ্ছে দুটো দেশ!

এ এক ভূ-রাজনৈতিক খেলা, এবং এই খেলায় পাকিস্তান এবং হিন্দুস্হান বরাবরই নিকৃষ্ট পথকে পছন্দ করে। এক স্বাধীন রাষ্ট্রকে প্রথমে নানা সুযোগ সুবিধার ওয়াদা করে শুধু আনুগত্যের কথা বলে অনুপ্রবেশ করে, তারপরেই প্রকাশ পায় তার আসল চরিত্র। যে দেশের জনগন পরাধিনতা চায়না তাদেরকে শাসন করার ভার বর্তমানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সাম্প্রদায়িকতার দেশকে কে দিয়েছে? এ আমার প্রশ্ন!

এবার অনেকেই ভাববেন এখানে পাকিস্তানকে কেন টেনে আনলাম, তার কারন বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই ১৯৪৭ সালে। দেশ ভাগের সময় যে সকল স্বাধীন রাজ্য তার স্বাধীনতা বজায় রেখে ভারত বা পাকিস্তান কোন অংশে যোগ না দিয়ে থাকতে চাইবে তাদের সে চাওয়াকে প্রাধান্য দেয়ার কথা ছিল (প্রিন্স স্টেিট)। সেই কারনে কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা হরি সিং স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার পক্ষে ছিলেন।

(কেন তিনি মুসলিম প্রধান কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ করলেন না এবং শেষে কেনইবা কাশ্মীরকে ভারতভূক্ত করলেন সেই কথা এই লেখার একেবারে শেষে বলবো) কিন্ত বিপত্তি বাঁধে ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টবর, যখন পাকিস্তান সমর্থিত পশতুন উপজাতিরা কাশ্মীর আক্রমণ করে। রাজা হরি সিং প্রতিরোধ গড়ে তোলেন কিন্ত তার সে প্রতিরোধ যথেষ্ট ছিলনা, তিনি হেরে যান এবং ভারতে আশ্রয় নেন এবং সাহায্য চাইলেন ইংরেজ লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে, নেহরুর কাছে এবং ভারত সরকারও প্রস্তুত ছিল সৈন্য প্রেরণে।

এই ব্রিটিশ জাতি বরাবরই কুটিল বুদ্ধির জাতি, তারা এমন ভাবে ছক কসে যা এতকাল পরে ভাবতে গিয়েও অবাক না হয়ে পারিনা। মাউন্টব্যাটেন শর্ত জুড়ে দিলেন, সাহায্য করতে পারি তবে তার বিনিময়ে কাশ্মীর রাজ্যেকে ভারতভুক্ত হতে হবে।
এ এক বড় সমীকরণ, হরি সিং তখন কি ভেবেছিলেন তা আমার জানা নেই তবে তিনি পা-হারানোর পরিবর্তে হাত হারাতে রাজি হলেন যা একরকম সমান ক্ষতিই বলা যায়। এবং এই সুযোগেই কাশ্মীরে প্রবেশ করে ভারতীয় সৈন্য।

এবার ভাবা যাক তাহলে সমস্যাটা কে তৈরী করলো? উত্তর হলো পাকিস্তান। পশতুন উপজাতির একার এত সামর্থ্য ছিলনা যে তারা কাশ্মীরকে দখল করে নিবে, নিশ্চয়ই তারা সাহায্য পেয়েছে পাকিস্তান থেকে।

এরপরে ১৯৪৭ এর ২৬ তারিখে হরি সিং মরণঘাতি ভারতভুক্তির সই করেন। এরপরেও দেশভাগ কালে গঠিত রাষ্ট্রসংঘ গণভোটের পক্ষে কথা বলে, পাকিস্তানের দখলকৃত আজাদ কাশ্মীর আর ভারতভুক্ত জম্মু কাশ্মীরের জনগন কি চায় তা দেখতে। কিন্ত ১৯৫২ তে জম্মু-কাশ্মীরের গণপরিষদ যখন ভারতের পক্ষে কথা বলে তখন ভারত গণভোটের দিকে আর এগোয় না, কারণ তাদের মনে ভয় ছিল অধিকাংশ মুসলিম জনগন হয়ত ভারতভুক্তির বিপক্ষেই রায় দিবে। এরপরেই কাশ্মীরের জনগনকে শান্ত রাখার পথ তৈরী করে ভারত, ৩৭০ ধারা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ধারাবলে কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত ও নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরীর অনুমতি দেয়।

বাহ্যিকভাবে একে সুন্দর নিয়ম মনে হলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি, কাশ্মীর ভারতের সংবিধান অনুসারেই শাসিত হতো। এছাড়া কাশ্মীরের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ এই তিনটি বিষয়ে চূরান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে ভারত ক্ষমতাধর ছিল এতকাল।
তাহলে বুঝাযায় ঐ ৩৭০ ধারা, নিজস্ব পতাকা রাখার বৈধতা এসবই ছিল চূরান্তভাবে ভারতভুক্তির পথের এক কুটিল কৌশল।

আমি চাইলে লেখাটা এখানেই শেষ করতে পারতাম কিন্তু তাতে প্রকৃত হরি সিং কে আড়ালে রাখা হবে। যা ঠিক নয়- এবার হরি সিং কে নিয়ে বিশ্লেষন করা যাক, হরি সিং (১৮৯৫-১৯৬১), ১৪ বছর বয়সে পিতা রাজা অমর সিং কে হারান এবং তিনিই ছিলেন কাশ্মীরের একমাত্র উত্তরাধিকারী এরপরে তার শিক্ষার দ্বায়িত্ব নেয় ব্রিটিশরা এবং তাকে ইংল্যান্ডের ইম্পেরিয়াল কলেজে পড়াশুনার ব্যবস্থা করে, সেখানে তাকে মিলিটারি ট্রেনিং ও দেয়া হয়। একারনে তাকে সামরিক পোষাকেই দেখা যেত।

প্রচুর টাকা পয়সা উড়াতেন এবং চরিত্রগত স্খলন তার স্বভাবের অংশ। ১৯২১ সালে প্যারিসে এক পতিতার করা মামলায় "তিন লক্ষ ডলার" জরিমানা প্রদান করতে হয়, আরো মজার বিষয় হলো ইন্ডিয়া সরকার মামলায় তার নামকে "Mr. A" তে রূপান্তর করে দেয় যাতে তা লোকসম্মুখে না আসে। এ ঘটনাকে কেউ আবার ব্ল্যাকমেইল ও বলে থাকেন। হিন্দু হওয়া সত্তেও তার চারটা বিবাহ ছিল একজন উত্তরসুরীর জন্য। তৎকালীন জওহরলাল নেহরু ও লর্ড মাউন্টব্যটেনের প্রিয়ভাজন ছিলেন হরি সিং।

জাতিগত ভাবে সনাতনধর্মী এবং শৈশব থেকে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বড় হওয়া হরি সিং এর পক্ষে মুসলিম প্রধান কাশ্মীরের জনগনের পাকিস্তানের অংশ হতে চাওয়া মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি।
মূলত দ্বি-জাতি তত্বের আলোকে ১৯৪৭ এর দেশ ভাগ হয়, সে হিসেবে মুসলিম গরিষ্ঠ কাশ্মীর হবে পাকিস্তানের অংশ অথবা স্বাধীন কিন্ত যখন কোন গনভোট ছাড়াই বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী কে ভারতের অংশ করে দেন হরি সিং তখন সেটা হয়ে দাঁড়ায় কাশ্মীরিদের জন্য এক কালো অধ্যায়।

হরি সিং তার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত বম্বেতে কাটান এবং তার ঐ ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর ভারতভুক্তির একটি মাত্র স্বাক্ষরের ফলে জম্মু, কাশ্মীর, লাখাদ, আকসাই চীন ভারতের অংশ হয়ে যায়।

এরপরের সত্যগুলো আমরা মোটামুটিরকম জানি। তথ্যমতে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রায় এক লক্ষ কাশ্মীরি প্রাণ হারিয়েছে, অঙ্গহানী হয়েছে আরো, বিবিসির তথ্য মতে গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বহু কাশ্মীরি নারী। জনগনের সেবার নামে যে বিশ্ব রাজনীতি এই পৃথিবীতে চলছে তা আসলে আত্নসেবা, মানবসেবা নয় এই সত্যটা বুঝতে পারলে এত দীর্ঘকালেও মানবিকতার বুলি আওড়ানো বড় বড় রাষ্ট্রোগুলো কেন কোন সুষ্ঠ সমাধানের কাজ করেনি তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

এর একটা সমাধান প্রয়োজন কিন্ত একটা মানুষ যখন ক্ষমতায় বসে তখন সে এক একটা জনগনের কথা ভাবতে ভুলে যায়, ভুলে যায় মানবিকতা এবং তার কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে তার অহংকার, ক্ষমতার প্রকাশ এবং অনমনীয়তা। যার ফলে একটা জনপদের মানুষের চাওয়াকে তারা আর মূল্যায়ন করে না, করতে চায়ও না।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ