শিক্ষক দিবস—শ্রদ্ধা, দায়িত্ব ও জাতি গঠনের অঙ্গীকার

লেখক মোঃ সাজ্জাদুল ইসলাম
লেখক মোঃ সাজ্জাদুল ইসলাম  © টিডিসি ফটো

আজ ৫ অক্টোবর—ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর এই দিনটি সারা পৃথিবীতে উদ্‌যাপিত হচ্ছে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন হিসেবে। এই দিবসের পেছনে রয়েছে এক গভীর তাৎপর্য। কারণ, শিক্ষক সমাজই জাতির প্রকৃত নির্মাতা, যাঁদের হাত ধরে গড়ে ওঠে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, বিকশিত হয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তাই এই দিনটি কেবল আনুষ্ঠানিকতার নয়, বরং আত্মসমালোচনারও—আমরা কি সত্যিই আমাদের শিক্ষকদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারছি?

একজন শিক্ষক কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান বিতরণ করেন না। তিনি শেখান মানুষ হওয়ার পাঠ, জাগান নৈতিকতা ও মানবিকতার বোধ। তিনি সমাজে আলোর প্রদীপ জ্বালান নিজের আত্মত্যাগের মাধ্যমে। একজন দক্ষ শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীর মেধাকে বিকশিত করেন, তেমনি তাঁর হৃদয়ে গেঁথে দেন মানবতার বীজ। ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের পেছনে শিক্ষকতার অবদান অনস্বীকার্য। সক্রেটিস, প্লেটো, কনফুসিয়াস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পর্যন্ত—সবাই ছিলেন সমাজ-মননের শিক্ষক, যাঁরা জ্ঞানের মাধ্যমে জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।

১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেসকো ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) শিক্ষকতার মানদণ্ড, অধিকার ও পেশাগত স্বাধীনতা বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক সুপারিশ পাস করে। সেই ঘটনার স্মৃতিচিহ্নেই ১৯৯৪ সালে ইউনেসকো দিনটিকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, এবং ১৯৯৫ সাল থেকে এটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষক পেশার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা, তাঁদের অধিকার ও সামাজিক অবস্থানকে দৃঢ় করা, এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁদের অবদানের প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া।

বাংলাদেশেও এই দিনটি পালিত হয় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলো শিক্ষক সম্মাননা ও আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকে। কিন্তু বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বলতে হয়—শিক্ষকদের জীবন এখনও নানা সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ। নিম্ন বেতন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, শিক্ষা অবকাঠামোর দুর্বলতা এবং সামাজিক অবমূল্যায়ন—সবকিছু মিলিয়ে অনেক শিক্ষক তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে গ্রামীণ শিক্ষকেরা অবকাঠামোগত সংকট ও সীমিত সুযোগের মধ্যে থেকেও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।

একটি জাতি যত উন্নতই হোক না কেন, তার শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষক সমাজের মান যতটা উন্নত, ততটাই টেকসই হয় সেই জাতির অগ্রগতি। তাই শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করা শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি জাতি গঠনের পূর্বশর্ত। রাষ্ট্রকে শিক্ষকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ, গবেষণা, ও কল্যাণমূলক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সমাজকেও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে আরও সচেতন হতে হবে। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষকের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলাই পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও মানবিক ও সচেতন করে তুলতে।

বিশ্ব শিক্ষক দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—একজন শিক্ষক কেবল শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন না, তিনি গড়ে তোলেন একটি জাতির চিন্তা, মূল্যবোধ ও ভবিষ্যৎ। তাই তাঁদের প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করা মানে একটি আলোকিত সমাজ নির্মাণের পথে অগ্রসর হওয়া। আসুন, এই দিনে আমরা প্রতিজ্ঞা করি—আমাদের প্রতিটি শিক্ষককে জানাব সত্যিকারের শ্রদ্ধা, তাঁদের অবদানকে স্মরণ করব কৃতজ্ঞচিত্তে, এবং শিক্ষা ও মানবতার পথে তাঁদের হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাব।

কারণ, শিক্ষকই সেই সূর্য, যিনি নিজেকে জ্বালিয়ে আলো ছড়ান চারপাশে। তাঁর আলোয়ই আলোকিত হয় আগামী দিনের পৃথিবী।

মোঃ সাজ্জাদুল ইসলাম

লেখক ও কলামিস্ট

 


সর্বশেষ সংবাদ