শিবিরকে উদাহরণ মানলে ধর্মীয় দলগুলো ক্ষমতার কাছে চলে আসতে পারে

পররাষ্ট্রনীতি ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ সাবিনা আহমেদ
পররাষ্ট্রনীতি ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ সাবিনা আহমেদ  © ফাইল ছবি

বাংলাদেশে ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো যদি কখনো ক্ষমতায় আসে, তাহলে কি দেশটি আফগানিস্তানের মতো তালেবান-শাসিত কঠোর ইসলামিক আইনের দিকে ধাবিত হবে? এ প্রশ্নটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনায় প্রায়শই উঠে আসে, বিশেষ করে আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুদ্ধারের পর। তবে, বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এমন কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।

ধর্মীয় উগ্রবাদ আর ধর্ম দিয়ে দমনের যে থ্রেসল্ড তা বাংলাদেশ বহুদিন আগেই পেরিয়ে গেছে। এ লেখায় কিছু ডাটা এবং তথ্যভিত্তিক যুক্তি দিলাম, যা দিয়ে বোঝা যায় কেন বাংলাদেশ কখনো আফগানিস্তানের মতো হবে না, এমনকি তার কাছাকাছিও না।

১. সামাজিক সমজাতীয়তা বনাম উপজাতিগত বিভক্তি: বাংলাদেশ একটি সমজাতীয় সমাজ, যেখানে জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশ বাঙালি, যারা ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধ। এখানে কোনো উল্লেখযোগ্য উপজাতিগত (tribal) বিভক্তি নেই, যা কোনো গোষ্ঠীকে অন্য গোষ্ঠীর উপর দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বাধা দেয়। অন্যদিকে আফগানিস্তান একটি বহুত্ববাদী (heterogeneous) সমাজ, যেখানে উপজাতিগত বিভক্তি গভীর। প্রধান জাতিগত গোষ্ঠীগুলো হলো পশতুন (৪২%), তাজিক (২৭%), হাজারা (৯%), উজবেক (৯%) এবং অন্যান্য।

তালেবান প্রধানত পশতুন উপজাতিভিত্তিক, যারা উপজাতিগত কোড এবং কঠোর ইসলাম মিশিয়ে শাসন করে, যা এই বিভক্তির কারণে সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে এমন বিভক্তি না থাকায় কোনো গোষ্ঠী দীর্ঘদিন অন্যকে দমন করতে পারবে না।

২. শহুরে জনগোষ্ঠী: বাংলাদেশের শহুরে জনসংখ্যা ৪১.২৩ শতাংশ (২০২৪ সালে), যেখানে আফগানিস্তানের শহুরে জনসংখ্যা মাত্র ২৭.২৬ শতাংশ (২০২৪ সালে)। শহুরীকরণ সমাজকে ফন্ডামেন্টলিযম কমাতে সাহায্য করে, বিশেষভাবে যুবকদের মধ্যে। এখানে আপনি হয়তো ইরানের উদাহরণ দেখিয়ে বলতে পারেন, তাহলে ইরানে ৭০ শতাংশ মানুষ শহুরে হয় সত্ত্বেও কেন ধর্মীয় শাসন সম্ভব হয়েছে; তার কারণ যুদ্ধ, আমেরিকা-ব্রিটেনের হেজেমনি, ইজরায়েলের ক্রমাগত হুমকি; যা আমাদের দেশের বেলায় প্রযোজ্য নয়। 

৩. উন্নয়নশীল দেশ: বাংলাদেশে অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সাম্প্রতিক অনুমান অনুসারে ২০২৫ সালে নামমাত্র জিডিপি প্রায় ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার হবে (পার ক্যাপিটা ২৬৯০ ডলার), আফগানিস্তানের জিডিপি নামমাত্র প্রায় ১৪.৫৮ বিলিয়ন ডলার (২০২১ সালে, ২০২৪ সালে ২.৫% বৃদ্ধি সত্ত্বেও সীমিত), উন্নয়নশীল দেশে ধর্মীয় দমন সহজে টিকবে না।

৪. দরিদ্রতা: বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার মাত্র ১৮.৭ শতাংশ (২০২২ সালে), এবং চরম দারিদ্র্যর হার মাত্র ৬.১ শতাংশ (২০২৪ সালে)। আফগানিস্তানে দারিদ্র্যের হার অত্যধিক—৬৪.৯ শতাংশ (২০২২-২৩ সালে), যা ২০২৪ সালে জীবিকা নিরাপত্তাহীনতায় ৭৫% পর্যন্ত উঠেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, চরম দারিদ্র্য ধর্মীয় চরমপন্থা (religious extremism) বা দমনকে সহজ করে, কারণ: দারিদ্র্য মানুষকে অস্থির করে, যা তাদের চরমপন্থী আইডিওলজিতে আকৃষ্ট করে।

৫. শিক্ষা: শিক্ষা একটি দেশের স্বাধীনতা এবং অধিকার-সচেতনতার মূল ভিত্তি। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ (২০২১ সালে), নারীদের ক্ষেত্রে ৭৪ শতাংশ, এবং যুবক-যুবতীদের (১৫-২৪ বছর) মধ্যে ৯৫ শতাংশ। প্রাইমারি ভর্তির হার ৯৮ শতাংশ, সেকেন্ডারি ৭০ শতাংশ। এই উচ্চশিক্ষার হার সমাজকে অধিকার-সচেতন করে তুলেছে ইতিমধ্যে। যা তালেবান-শৈলী নিষেধাজ্ঞা (যেমন মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ) মেনে নেবে না।

আফগানিস্তানে সাক্ষরতার হার মাত্র ৩৭ শতাংশ (২০২১ সালে), নারীদের ক্ষেত্রে ২২.৬ শতাংশ। তালেবানের শাসনে মেয়েদের সেকেন্ডারি শিক্ষা বন্ধ, যার ফলে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন মেয়ে ঘরবন্দি। যুদ্ধ এবং অস্থিরতা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ এমন দমনমূলক নীতি সহ্য করবে না, কারণ শিক্ষা মানুষকে তাদের অধিকার রক্ষায় সক্ষম করে।

৬. নারী-বান্ধব সমাজ এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: বাংলাদেশ মূলত নারী-বান্ধব, যেখানে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ ৪৪.১৫ শতাংশ (২০২৪ সালে), গার্মেন্টস খাতে ৮০%। গত কয়েক দশকে দুই নারী নেত্রী (শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া) দেশ শাসন করেছেন, যা নারী নেতৃত্বের প্রমাণ। নারী-সমর্থক আইনগুলো (যেমন নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন) ভারত বা পাকিস্তানের চেয়েও অগ্রসর, যা নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেয়।

নারীদের দমন করলে গার্মেন্টস রপ্তানি (প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার) হুমকির মুখে পড়বে, যা কোনো সরকার ইমপ্লিমেন্ট করবে না। করতে চাইলেও পারবে না। দেশের মানুষ মানবে না। আফগানিস্তানে নারী শ্রমশক্তি অংশগ্রহণ মাত্র ৫.১ শতাংশ (২০২৪ সালে), তালেবানের নিয়মে নারীরা পুরুষ অভিভাবক ছাড়া বাইরে যেতে পারে না, চাকরি নিষিদ্ধ। এ পার্থক্য বাংলাদেশকে তালেবান-শৈলী থেকে দূরে রাখে।

আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা প্রত্যাশীদের জন্য দুঃসংবাদ

৭. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ইতিহাস: ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ কোনো বড় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যায়নি, যা তার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছে। গত ৫৪ বছরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যদিও অসম্পূর্ণ, উন্নয়নকে অগ্রসর করেছে। আফগানিস্তান গত ৪০ বছরে অবিরাম যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত, যা তালেবানকে কঠোর শাসনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে  এমন কঠোরতা অসম্ভব। 

৮. বাংলাদেশের ইসলাম: প্রথম থেকেই বাংলাদেশের ইসলাম সুফি-মিশ্রিত, যা সহনশীলতা এবং সমন্বয়ের উপর ভিত্তি করে, তালেবানের কঠোরতা ফিট করে না। ইসলামিক দলগুলোর কোনো কঠোর শরিয়া বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা নেই, এবং তারা জানে যে এমন চেষ্টা সমাজ থেকে প্রতিরোধের মুখে পড়বে।

৯. অর্থনীতি:  বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানি-মুখী, যেখানে নারীদের অবদান অর্ধেকের কাছাকাছি। তালেবান-শৈলী হলে রপ্তানি বন্ধ, বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে, যা হলে জনগণ অল্প দিনের  মধ্যেই সরকারকে উৎখাত করবে। 

এই দেশে ইসলামিক দলগুলো কনজারভেটিভ নীতি উৎসাহিত করবে, কিন্তু জোরপূর্বক বোরকা বা অনুরূপ নিয়ম চাপিয়ে দিতে পারবে না, মেয়েদের শিক্ষা কিংবা চাকরি বন্ধ করতে পারবে না। কারণ তাহলে সমাজে বিস্ফোরণ ঘটবে। দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে, এবং ক্ষমতায় থাকলে তারা ক্ষমতাচ্যুত হবে। এসব ক্যালকুলেশন এই দলগুলো করছে বলেই আমার বিশ্বাস। আর করছে বলেই আমরা দেখেছি, আজকের শিবির আর ৩০ বছর আগের শিবির এক নয়, সেখানে আমুল পরিবর্তন আনা হয়েছে।

ধর্মীয় মূল্যবোধ একটি দেশের জনগণকে সৎ থাকতে, আর সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে। একটা ন্যায় আর নিরাপদ সমাজ গঠন করে। কিন্তু অতি কঠোরতা বাংলাদেশে  টিকবে না। দেশের সকল ইসলামীকদলগুলো সেই অনুযায়ী হিসাব নিকাশ  করে রাজনীতি করলে ভালো হয়। শিবিরকে তারা উদাহরণ হিসাবে নিলে তারা দেশের মানুষের মন জয় করে ক্ষমতার অনেক কাছে চলে আসতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক: পররাষ্ট্রনীতি ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ


সর্বশেষ সংবাদ