বাবা দিবসে কুবি শিক্ষকদের স্মৃতি রোমন্থন 

বাবা দিবসে কুবি শিক্ষকদের স্মৃতি রোমন্থন 
বাবা দিবসে কুবি শিক্ষকদের স্মৃতি রোমন্থন   © টিডিসি

জীবনের প্রতিটি বাঁকে, যেখানে মায়ার স্পর্শ একটু কমে আসে, সেখানে এক শক্ত হাত ঠিকই আমাদের পাশে থাকে- সে হাত বাবার। বাবা মানে নির্ভরতার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। প্রতিদিনের নিরব ভালোবাসা, নির্লোভ ত্যাগ আর কঠোর পরিশ্রমে তিনি আমাদের জীবনের ভিত্তিটাকে গড়ে তোলেন নিঃশব্দে। সেই বাবার জন্যই আজকের দিন- বাবা দিবস।

শিশুকাল থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন জীবনের প্রতিটি ধাপে বাবার ভূমিকা থাকে অদৃশ্য অথচ অমোঘ। তিনি হয়তো মায়ের মতো বারবার জড়িয়ে ধরেন না, কিন্তু তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত, পরামর্শ, নিঃশব্দ উপস্থিতি সন্তানের জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। বাবার ভালোবাসা ঠিক নদীর মতো প্রবল অথচ গভীর, দৃশ্যমান নয়, কিন্তু প্রবহমান।

জুন মাসের তৃতীয় রবিবার পৃথিবীর বহু দেশে পালিত হয় বাবা দিবস। এই দিনটি শুধুমাত্র বাবাকে উপহার দেওয়ার জন্য নয়, বরং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি প্রতীকী উপলক্ষ্য। যারা বলিষ্ঠ এই পুরুষটির কাঁধে ভর দিয়ে জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছেন, তারা জানেন বাবা কেবল পরিবার প্রধান নন, তিনিই প্রথম আদর্শ, প্রথম হিরো। বাবা দিবসে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের প্রতিনিধির সাথে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন কুবি শিক্ষকগণ।

নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাসিনা বেগম বলেন, 'প্রত্যেক সন্তানের জীবনে বাবা হলো পরম নির্ভরতা ও আশ্রয়স্থল। বাবা রা যিনি যেই অবস্থানে ই থাকুন না কেন, তাদের সবটুকু সামর্থ্য নিয়ে হাসিমুখে তারা সন্তানের পাশে থাকেন। পৃথিবীর সকল সফল সন্তানের পেছনে থাকে বাবাদের  দীর্ঘ ত্যাগের ইতিহাস, কিন্তু তার বিনিময় তারা কখন ও কিছু আশা করেন না। তথাপি সন্তান হিসেবে আমাদের ও কিন্তু নৈতিক দায়িত্ব আছে। বার্ধক্যে বাবা রা যখন শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে যান তখন সন্তান হিসেবে আমাদের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো, যেভাবে তারা শিশুকাল থেকে আমাদের জন্য করেছেন। পৃথিবীর সকল বাবা তাদের সন্তানদের যত্ন ও ভালোবাসায় থাকুন, বাবা দিবসে এই প্রত্যাশা ই করি।'

আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু বকর সিদ্দিক (বাবু) বলেন, 'আমার বাবার কোনো ছবির অ্যালবাম নেই। মায়ের শাড়ি, চুলের ক্লিপ, পুরনো চিঠি, ছোটবেলার জামা—এসব যত্নে রাখা হয়। কিন্তু বাবার কিছু নেই। বাবারা নিজেরাই যেন এক অতীত, যেটা জমা হয়ে থাকে, কিন্তু আমরা আর খুঁজি না। ছোটবেলায় মনে হতো বাবা একটা শক্ত দেয়াল। যার পেছনে দাঁড়ালে কেউ কিছু করতে পারবে না। বড় হয়ে বুঝেছি—ওই দেয়ালটার ফাটল ছিল। সেটা তিনি দেখাতেন না। বরং সবসময় পাশে থাকেন— ছায়ার মতো। ছায়ারা কোনো দাবি রাখে না। তারা শুধু রোদ থেকে আগলে রাখে চুপচাপ। বাবারা এমনই। তাঁরা সমুদ্রের মতো—দূর থেকে শান্ত দেখায়, কিন্তু তার ভেতরে কত ঢেউ, কত উত্তাল স্রোত—তা আমরা বুঝতে পারি না।'

তিনি আরও বলেন, 'আমার বাবাকে নিয়ে বলার মতো কোনো নাটকীয় গল্প নেই।তিনি কাউকে বাঁচিয়ে ফেরেননি,বড় কোনো পুরস্কারও পাননি। তবুও তিনি আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা মানুষ। কারণ তিনি আমাকে প্রতিদিন একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন; নিজেকে ভেঙে। আমি চাই না তিনি কোনোদিন বৃদ্ধ হোন। আমি চাই না তাঁর চুলে পাক ধরুক। আমি শুধু চাই-আমার পাশে এমন একজন থাকুক, যিনি কিছু না বলেই বলে দিতে পারেন, “ভয় পাইস না বাপ, আমি আছি।” 
আজ বাবা দিবসে, আমি পত্রিকার পাতায় নয়, নিজের হৃদয়ে বড় করে লিখে রাখি “বাবারা আকাশের মতো সবসময় মাথার ওপরে থাকেন, আমরা শুধু তাকিয়ে দেখি না।"

আইসিটি বিভাগের প্রভাষক খন্দকার অলিউল্লাহ বলেন, 'বাবা: আমার নীরব শিক্ষক। ছোটবেলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পর্যন্ত আমি বেড়ে উঠেছি এক পুরোদস্তুর মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে। আমাদের পরিবারটা যেন ছিল এক ছোটখাট সমাজ—চাচা, চাচি, চাচাতো ভাইবোন মিলিয়ে সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ জন। বাবার পাশাপাশি আমার চাচারাও ছিলেন বিভিন্ন পেশায় যুক্ত। কিন্তু পরিবার পরিচালনার মূল দায়িত্বটা ছিল এককভাবে বাবার হাতে।

বাবা ছিলেন আমাদের সবার অবলম্বন, সবার নির্ভরতার প্রতীক। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে আমি ভর্তি হই ঢাকার একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরপর কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পর্যন্ত পৌঁছাই। এই দীর্ঘ শিক্ষাজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে ছাত্রাবাস বা হলের ছোট্ট একটা রুমে। বাবা প্রতি মাসে নিয়ম করে খরচের টাকা পাঠাতেন—যতটুকু দরকার, ততটুকুই। কখনো তার চেয়ে বেশি নয়। অর্থের অভাব আমাদের ছিল না, তবে বাবা কখনোই বিলাসিতা শেখাননি। তিনি চেয়েছিলেন আমরা জীবন শিখি—মুল্যবোধ, দায়িত্ববোধ আর আত্মনির্ভরতার শিক্ষা যেন আমাদের ভিত গড়ে তোলে।

তিনি আরও বলেন, 'আজ বুঝি, বাবা আমাদের এই সীমিত আরাম আর স্বাবলম্বিতার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন এক ধরনের দূরদর্শী পরিকল্পনা থেকেই। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন আমাদের পথ চলাটা হোক বাস্তব অভিজ্ঞতায় গড়া—যাতে ভবিষ্যতের প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা সচেতন থাকতে পারি। আমার বাবা শুধু একজন অভিভাবক নন—তিনি একজন নীরব শিক্ষকের মতো, যিনি সংসারের ভেতরেই তৈরি করে দিয়েছিলেন একটি বাস্তব জীবন বিদ্যালয়। সেখানে শিখেছি কিভাবে সীমিত সম্পদে চলতে হয়, কিভাবে দায়িত্ব নিতে হয়, আর কিভাবে আত্মমর্যাদার সঙ্গে জীবনকে এগিয়ে নিতে হয়।'


সর্বশেষ সংবাদ