নৌকা ভ্রমণের দিনলিপিতে খোলপেটুয়া নদীর সৌন্দর্য
- হুমায়ন কবির মিরাজ
- প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫, ০৮:৫৮ AM , আপডেট: ১৩ জুন ২০২৫, ০৮:৩২ AM
নদী বাঙালির প্রাণ। এই দেশের নদ-নদী শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর সেই নদীর বুকেই যখন ছুটে চলে একখানা ছোট্ট নৌকা, চারপাশে ঝিকিমিকি রোদ, আর বাতাসে ভেসে আসে গ্রামীণ গন্ধ—তখন সময় যেন থমকে দাঁড়ায়। এমনই এক অভিজ্ঞতা হলো ১০ জুন, সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার খোলপেটুয়া নদীতে।
আমরা ভ্রমণে গিয়েছিলাম যশোরের বেনাপোল থেকে। সহযাত্রী ছিলেন এশিয়ান টেলিভিশনের যশোর জেলা প্রতিনিধি সেলিম আহমেদ, রূপান্তর প্রতিদিন পত্রিকার সাংবাদিক কামরুজ্জামান এবং আমাদের প্রিয় বন্ধু হাফিজুর রহমান হাফিজ। একসাথে পথচলা, গল্প আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটানো সময়—সব মিলিয়ে দিনটি হয়ে ওঠে এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলাকে দু’ভাগে বিভক্ত করে প্রবাহিত এই খোলপেটুয়া নদী যেন এক জলরঙে আঁকা সোনালি রেখা। এই নদী কেবল জল নয়—বয়ে আনে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নিখাদ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তারই বুকে দাঁড়িয়ে থাকা মানিকখালি ব্রিজ একদিকে স্থাপত্যের সাক্ষ্য, অন্যদিকে নৈসর্গিক দৃশ্যের অনুপম প্রতীক। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে একবার চারপাশে চোখ বোলালেই বোঝা যায়, প্রকৃতি কীভাবে নিঃশব্দে রঙের খেলায় মগ্ন থাকে।
এই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে। কেউ আসে দিনের সূর্যাস্ত দেখতে, কেউ বা শুধু নদীর পাড়ে কিছুটা সময় কাটাতে। মানিকখালি ব্রিজ ও খোলপেটুয়া নদীর মিলিত সৌন্দর্য যেন স্থানীয় পর্যটনের এক অনন্য স্থান হয়ে উঠেছে। শহরের কোলাহল থেকে বেরিয়ে গ্রামীণ পরিবেশে একটু প্রশান্তির খোঁজে এ জায়গা হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে বিশেষ গন্তব্য।
নৌকা যখন নদীর ঢেউ ছুঁয়ে এগিয়ে চলে, তখন দুই কূলের দৃশ্য যেন জীবন্ত চিত্রপট। সবুজ খেত, সারি সারি গোলপাতা গাছ ও কেওড়া গাছ, জেলেদের জাল ফেলার দৃশ্য—সব মিলিয়ে মনে হয়, এ এক চলমান কবিতা। পানির রং হালকা ঘোলা হলেও, সূর্যের আলো পড়লে তার প্রতিফলনে যে জাদু সৃষ্টি হয়, তা শুধু চোখে নয়, মনেও আলোড়ন তোলে।
মানিকখালি ব্রিজ এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে শুধু যাতায়াতের পথ নয়—এটি ভালোবাসা, স্মৃতি আর অপেক্ষার প্রতীক। ব্রিজে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা যেন কোনো সিনেমার দৃশ্য, যেখানে আকাশের গাঢ় কমলা আর নদীর জলে মিশে যাওয়া ব্রিজের প্রতিচ্ছবি এক অমলিন শিল্পকর্ম। নৌকা থেকে তাকালে সেই দৃশ্য আরও মায়াবী লাগে—জল হালকা দুলছে, যেন কোনো সঙ্গীতের ছন্দে।
খোলপেটুয়া নদী ও মানিকখালি ব্রিজ ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি বৈচিত্র্যময় জনপদ। মৎস্যজীবী, কৃষক, মাঝি—তাঁদের জীবনযাপন নদীর সঙ্গেই জড়িত। নৌকা বেয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে শামুক কুড়ানো, কাঁকড়া ধরা, আর নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া শিশুদের নিষ্পাপ উল্লাস—সব মিলিয়ে এটি এক অনাবিল গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি।
তবে এই সৌন্দর্যের মাঝেও লুকিয়ে আছে কিছু উদ্বেগ। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ রক্ষা, ব্রিজের সংরক্ষণ এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখা এখন জরুরি। অবহেলা করলে এমন এক অপূর্ব সৌন্দর্য হয়ত কেবল ছবিতে আর স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।
ভ্রমণ শেষে যখন ঘাটে পা রাখলাম, মনে হলো—এটি কোনো সাধারণ নৌকা ভ্রমণ ছিল না, ছিল এক ধরনের আত্মশুদ্ধির অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির এত কাছে গিয়ে জীবনকে যেন নতুন চোখে দেখা যায়। আশাশুনির খোলপেটুয়া নদী আর মানিকখালি ব্রিজ যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বাংলা এখনও জীবন্ত, প্রকৃতি এখনও কথা বলে, কেবল আমাদের দরকার সময় নিয়ে তাকানো।
লেখক: সংবাদকর্মী।