করিডোর নাকি বিপদ? সার্বভৌমত্ব নিয়ে ভাবনার সময় এখন

মো. মোফাজ্জল হক
মো. মোফাজ্জল হক  © টিডিসি ফটো

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাখাইনের মধ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশের ওপর করিডোরের প্রস্তাব নতুন এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রাখাইনের সাথে মানবিক সহায়তার কথা বলা হলেও, বাস্তবিক বিচারে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। তাই, করিডোর স্থাপনের আগে এর সম্ভাবনা ও ঝুঁকি দুটিকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করা জরুরি।

রাখাইনের করিডোর কোনো সরল বাণিজ্যিক প্রকল্প নয়; এটি একটি জটিল ভূরাজনৈতিক উদ্যোগ, যার গভীরে রয়েছে নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি ও জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্ন। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত করিডোরের সম্ভাব্য সুফলকে আমলে নেওয়ার আগে সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা।

বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির সূক্ষ্ম ছকে ভূ-অবস্থান এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান তাকে আঞ্চলিক সংযোগের একটি স্বপ্নময় কেন্দ্রে পরিণত করেছে। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই রাষ্ট্রটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মেলবন্ধনের এক অপরিহার্য সেতুবন্ধন হয়ে উঠেছে। এই পটভূমিতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব নতুন করে আলোচনায় এসেছে। তবে করিডোর বাস্তবায়নের ইচ্ছা যতই আশাজাগানিয়া হোক না কেন, এর অন্তর্নিহিত বিপদ ও সম্ভাব্য ঝুঁকির পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ ছাড়া একক কোনো সিদ্ধান্ত জাতীয় স্বার্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

করিডোর ব্যবস্থাপনার অর্থই হলো, বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে একটি ভিন্ন রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ চলাচলের সুবিধা দেওয়া। ইতিহাসের আলোকে বললে, এ ধরনের ব্যবস্থাপনা কখনোই নিছক মানবিক বা বাণিজ্যিক রয়ে যায় না; সময়ের প্রবাহে তা নিরাপত্তা, ভূরাজনীতি ও সার্বভৌম সিদ্ধান্তের জটিল জালে জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের জন্য এ করিডোর স্থাপনা মানে একটি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ঝুঁকির দ্বার খুলে দেওয়া যা ভবিষ্যতে সন্ত্রাসবাদ, মাদকপাচার, অস্ত্র পাচার কিংবা মানবপাচারের অনুপ্রবেশের পথ সুগম করে দিতে পারে।

বর্তমানে রাখাইনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির দিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। রাখাইন রাজ্য বহু বছর ধরেই জাতিগত সংঘাতের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। রোহিঙ্গা নিপীড়নের করুণ ইতিহাস বাংলাদেশের ওপর যে শরণার্থী চাপ সৃষ্টি করেছে, তার ক্ষত এখনো দগদগে। বাংলাদেশ এখন রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য করিডর দিলেও তাতে আদৌ রাখাইনের বেসামরিক নাগরিকদের লাভ হবে কি-না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ আরাকান আর্মির রসদ সরবরাহের অন্য পথ বন্ধ করে রেখেছে জান্তা সরকার। এই বাস্তবতায় রাখাইনমুখী একটি করিডোর খুলে দিলে সেখানে পুনরায় সহিংসতার বিস্তার ঘটলে বাংলাদেশ সরাসরি নতুন করে শরণার্থী প্রবাহ ও জাতিগত উত্তেজনার সম্মুখীন হতে পারে। একইসঙ্গে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও অস্বীকার করার উপায় থাকবে না।

করিডোর ব্যবহারে বাংলাদেশি ভূখণ্ডে বিদেশি রাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার স্বীকৃতি পেতে পারে, যা ভবিষ্যতে সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা হতে পারে। অস্ত্র, মাদক, মানবপাচার এবং জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের আশঙ্কা বাড়বে। এমনকি সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হবে, যা রাষ্ট্রের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। রাখাইন অঞ্চলের বিদ্যমান জাতিগত সংঘাত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যান্য বৃহৎ শক্তির ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের সংঘাতে বাংলাদেশ অনিচ্ছাকৃতভাবে জড়িয়ে পড়তে পারে। রাখাইন অঞ্চলে যদি সহিংসতা বাড়ে, তবে আবারও বাংলাদেশে শরণার্থী প্রবাহ তৈরি হতে পারে।

আরও বড় যে ঝুঁকি সামনে এসে দাঁড়াবে, তা হলো ভূরাজনৈতিক চাপের বিষয়টি। রাখাইন রাজ্যে চীন ইতোমধ্যে তার প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। চীনের ‌‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে রাখাইন সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক করিডোর ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে, ভারতও রাখাইনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। ফলে, বাংলাদেশ যদি এই করিডোর প্রকল্পে অংশ নেয়, তবে তাকে চীন-ভারত-আসিয়ান-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রতিযোগিতার জটিল খেলায় জড়িয়ে পড়তে হবে। বাংলাদেশের নিরপেক্ষতা ও কৌশলগত ভারসাম্য তখন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে, যার সুদূরপ্রসারী ফলাফল অনাকাঙ্ক্ষিত।

করিডোর ব্যবস্থাপনায় বিরাট অর্থনৈতিক ব্যয়ও রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে, তা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য সহজ বিষয় নয়। উপরন্তু, সীমান্ত এলাকার সামাজিক কাঠামোতে করিডোরের ফলে যে পরিবর্তন আসবে, তা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হতে পারে।

বাংলাদেশে করিডোর অনুমোদনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে সক্রিয় নিষিদ্ধ জাতিগত সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আরও বেগবান হতে পারে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় হত্যা, লুটপাট, মুক্তিপণ দাবিসহ একাধিক সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে তারা। রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার নয়টি উপজেলা নিয়ে পৃথক স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তৎপর মিয়ানমারের কুকি-চিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। রাখাইনের নিকটবর্তী চিন রাজ্যে এবং বাংলাদেশের ত্রিপুরা-মিজোরাম সীমান্তে এই গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ক্রমেই উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মূলত জাতিগত স্বায়ত্তশাসন ও অধিকারের দাবিতে পরিচালিত এই আন্দোলন এখন ক্রমশই সশস্ত্র হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে কুকি চিন বিদ্রোহীদের অবস্থান মানে, এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বাড়বে এবং একটি সুদীর্ঘ লড়াইয়ের মঞ্চ তৈরি হতে পারে।

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে করিডোর স্থাপনের ফলে ভয়াবহ বিপর্যয়ও নেমে এসেছিল তা আমাদেরকে কয়েকবার ভাবতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে পোল্যান্ডকে বাল্টিক সাগরের সাথে সংযোগ দেওয়ার জন্য জার্মান ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ‘ড্যানজিগ করিডোর’ বা পোলিশ করিডোর তৈরি করা হয়েছিল। জার্মানি এই করিডোর নিয়ে অস্বস্তি অনুভব করছিল এবং হিটলার এটিকে জাতীয় অপমান হিসেবে মনে করত। ফলাফলস্বরূপ হিটলার সর্বপ্রথম ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড আক্রমণ করে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটায়।

রাখাইনের জন্য করিডোর স্থাপন করে আমাদের সার্বভৌমত্বে যে কুকি চিন সন্ত্রাসীদের মতো আরেকটি নাৎসি দলের উত্থান হবেনা তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে কেউ? যদি নীতিনির্ধারণী জায়গা থেকে এসব না ভাবা হয় তাহলে মাতৃভূমির উপর অমাবস্যা ঘনিয়ে আসতে পারে। 

কেবল মানবিক দিক বিবেচনায় যদি বাংলাদেশ এই করিডোর বাস্তবায়নে এগিয়ে যায়, তবে সাময়িক সুবিধার বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের দায়ভার বইতে হতে পারে। ইতিহাস সাক্ষী, ভূরাজনীতিতে ছোট একটি ভুল সিদ্ধান্তও বহু দশক ধরে একটি জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। সেই পাঠ আমাদের মনে রাখতে হবে।

দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ উন্নয়নকে সামনে রেখে রাখাইনের করিডোর প্রসঙ্গে বাংলাদেশের উচিত হবে অতি সতর্ক ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কোনো অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত যেন জাতির জন্য অনুশোচনার কারণ না হয় এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


লেখক, শিক্ষার্থী 
সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence