ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের মূল কারণ ও বাস্তবমুখী সমাধান
- ড. শাহজাহান খান
- প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:১৪ PM , আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:১৪ PM
জ্বলছে গাজা, মরছে মানুষ। স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে গাজা উপত্যকার আকাশ বাতাস। চারিদিকে চলছে নির্বিচারে মানুষ হত্যার মহোৎসব! অবুঝ শিশু, অসহায় নারী, বয়স্ক-বৃদ্ধ মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এরইমধ্যে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার নিরপরাধ জনগণের ওপর ভয়াবহ সামরিক আক্রমণ চালাচ্ছে ইসরায়েল। গাজার মাটি থেকে ফিরিস্তিনিদের চিরতরে উৎখাত করতে সর্বাত্মক সংঘাতের পথে হাঁটছে তারা।
১৯৪৮ সাল থেকেই বিশ্ববাসী নীরব দর্শকের মতো দেখছে তাদের বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ! কী স্থলপথ, কী আকাশ, সব পথেই আগ্রাসী হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কমিউনিটি সেন্টার, বাড়ি-ঘর এমন কী হাসপাতালের মতো স্থাপনাও রক্ষা পাচ্ছে না ইসরায়েলি বাহিনীর বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে। অসহায় নারী, বয়স্ক ও শিশুসহ শত শত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে প্রতিদিন। যে নৃশংসভাবে একের পর এক স্থল ও বিমান আক্রমণ চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী, এতে অনিশ্চিত যে এ আক্রমণের মুখে কতজন নির্দোষ এবং আটকে পড়া ফিলিস্তিনি শেষ পর্যন্ত প্রাণ বাঁচাতে পারবে। যুদ্ধ নয়, যেন জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের নারী ও শিশুদের সাথে পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করছে তারা।
২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী ৫ হাজার ৭৩৯ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। যেখানে ফিলিস্তিনিদের হাতে নিহত হয়েছে তাদের ২৫১ জন। প্রতি ১ জন ইসরায়েলির জন্য ২৩ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে! একই সময়ে ১ লাখ ২১ হাজার ৪৩৮ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে। যার বিপরীতে ইসরায়েলি আহত হয়েছে ৫ হাজার ৬৮২ জন।
কেন করছে তারা এটা? জাতিগত নিধন কেন তাদের কাছে অপরাধ নয়? অবাক করা বিষয় হলো, বিশ্ববাসীও যেন তাদের এ অপরাধের ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে! সকলের চোখের সামনেই গাজায় নারকীয় তান্ডব চালাচ্ছে ইসরায়েলি ইহুদীবাদী বাহিনী। অথচ তা বন্ধ করার মতো কেউ নেই। ইসরায়েলি বর্ণবাদীদের আধিপত্ত এতই প্রবল যে, জাতিসংঘের আহবানও কানে তুলছে না তারা। উল্টো জাতিসংঘের দিকেও চোখ রাঙাচ্ছে ইসরায়েল।
একটা স্বাধীন ভূ-খন্ডের জন্য বহু বছর ধরে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর সাথে লড়াই-সংগ্রাম করছে ফিলিস্তিনের জনগণ। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস লড়াই করছে স্বাধীনতার পক্ষে। গত ৭ অক্টোবর-২০২৩ এর প্রথম দিকে ইসরায়েলের প্রাচীর ঘেরা সুরক্ষিত সীমানার ভেতরে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় আক্রমণ চালিয়েছে তারা। বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক সামরিক ও প্রযুক্তির অধিকারী পরাশক্তি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাসহ কেউ অনুমান করতে পারেনি তাদের এ হামলার ব্যাপারে। হামাসের আকস্মিক এ সফল আক্রমণে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)সহ গোটা বিশ্বের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে গেছে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত, নাকবা বা “মহা বিপর্যয়ের” সময়, ইহুদিবাদী সামরিক বাহিনী কমপক্ষে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে বহিষ্কার করে এবং ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের ৭৮ শতাংশ জমি দখল করে নেয়। অবশিষ্ট ২২ শতাংশ পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় বিভক্ত ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময়, ইসরায়েলি বাহিনী সমস্ত ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন দখল করে এবং আরও ৩০ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর থেকে উৎখাত করে—আল জাজিরার প্রতিবেদন
হামাসের এ আক্রমণ আপাত আকস্মিক মনে হলেও কোনোভাবেই তা হঠাৎ শুরু করা কোনো আক্রমণ নয়। বহু বছর ধরে যে নিধন নিপীড়ন চলছে ফিলিস্তিনের ভূমিতে, এ তারই প্রতিরোধ। যেদিন থেকে ইহুদীবাদীরা ফিলিস্তিনের ভূমিতে জোর করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার দখলদারিত্ব শুরু করেছে, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধ। হামাসের এবারের আক্রমণ ছিল ফিলিস্তিনের মানুষের দীর্ঘ প্রতিরোধ সংগ্রামেরই একটা পর্যায়। আর এতেই আবারও আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের সংবিধান জানা কি জরুরি নয়?
স্বাধীনতাকামী হামাসের আক্রমণের জবাবে তারা গাজার নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর চালাচ্ছে বর্বর হত্যাযজ্ঞ। দুঃখজনকভাবে, উভয় পক্ষের লড়াইয়ে হাজার হাজার নিরীহ পুরুষ, মহিলা ও শিশু বাড়িতে ও হাসপাতালে নিহত হয়েছে। বরাবরের মতো প্রায় সমস্ত পশ্চিমা শক্তি এবং তাদের নেতারা, মারডক মিডিয়া সংঘসহ সকলের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে ইসরায়েলের প্রতি। সেই সাথে তাদের দেওয়া অপরিমেয় সামরিক তহবিল ব্যবহার করে ইহুদিবাদী সেনাবাহিনী যতটা সম্ভব নির্দোষ ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করে তাদের বর্ণবাদী রাষ্ট্র সুরক্ষিত করতে এবং বিদেশী ইহুদিদের জন্য অবৈধ বসতি প্রসারিত করতে তৎপর রয়েছে।
গত বছর গাজাভিত্তিক মার্কিন-আরব খ্রিস্টান সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। সাংবাদিকদের সুরক্ষা কমিটি (সিপিজে) বলেছে, বিগত ২২ বছরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে মারা গেছে ২০ সাংবাদিক। তবে এর জন্য কাউকে কখনো জবাবদিহি করতে হয়নি। কারো কোনো বিচার হয়নি। ২০০৩ সালের ১৬ মার্চ গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক এক হাজারের অধিক ফিলিস্তিনি বসতবাড়ী ধ্বংস করার প্রতিবাদ করায় র্যাচেল কোরি নামক ২৩ বছর বয়সী এক আমেরিকান নারীকে বুলডোজার দিয়ে পিষে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। ২০১২ সালে কোরির বাবা-মায়ের করা মামলার শুনানীটা পর্যন্ত করতে প্রত্যাখ্যান করেছে হাইফার একজন জায়নবাদী বিচারক।
আকাশ, নৌ ও স্থল পথে বেপরোয়া আক্রমণ চালাচ্ছে একের পর এক। ফলে গাজা উপত্যকায় বসবাসকারী প্রায় ২.৫ মিলিয়ন মানুষ কার্যত দিন কাটাচ্ছে বৃহৎ এক খাঁচায় বন্দি পশুর মতো। তাদের ভাগ্যে যে ঠিক কী আছে, তা কেবল ইসরাইল এবং তার রক্ষকরাই জানেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসরায়েল-বিরোধী সংগঠন ও কর্র্মীগণ বিভিন্ন গণমাধ্যমে হামাসের মাতৃভূমি উদ্ধারের প্রচেষ্টার প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করেছে। তারা হামাসের আশ্চর্য আক্রমণকে দখলদারিত্ব বিরোধী সংগ্রামের একটি স্বাভাবিক বিস্ফোরণ হিসেবে দেখছে। তারা মনে করছে স্বাধীনতা ও স্বাধীন ভূ-খন্ডের অধিকার অন্যান্য জাতির মতো ফিলিস্তিনিদেরও রয়েছে। নিজভূমে পরবাসী ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য একটি "প্রতিরোধ" হিসেবে চিহ্নিত করছে তারা হামাসের পদক্ষেপকে। এমনকি অনেক ইহুদিরাও ইসরায়েলের চলমান আগ্রাসী ইহুদিবাদ এবং বর্ণবাদী রাষ্ট্র নীতির বিপক্ষে সোচ্চার। ইসরায়েলের চলমান নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে তারা। তারা মুক্ত ফিলিস্তিন আন্দোলনকে সমর্থন করে। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে বলে মনে করে।
ভয়াবহ অমানবিক জীবন গাজায় অবরুদ্ধ সমস্ত ফিলিস্তিনিদের। তাদের বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়া সমস্তটাই এখন কার্যত ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। গাজার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে তারা। গাজাবাসীদের জন্য খাদ্য, পানি, জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং সমস্ত প্রয়োজনীয় সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম ‘ওপেন এয়ার জেল, উন্মুক্ত জেলখানা’ বলে অভিহিত করেছেন। পরিহাসের বিষয় হলো, ইসরায়েলিরা জোরপূর্বক স্থানীয় আরবদের নিজেদের বাড়ি ও ভূমিতেই শরণার্থী বানিয়ে রেখেছে। তাদের বতববাড়ী, ফসলের ক্ষেত, পশু খামারসহ সব আজ ওদের দখলে।
“ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাপ্তি সহজ: ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেবল আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করতে হবে। ইসরায়েল যদি ২০০৬ সালের জানুয়ারির ফিলিস্তিনি নির্বাচনের ফলাফলকে অনুমতি দিত, বিজয়ীদের শাসনের অনুমতি দিত এবং গাজা বন্ধ না করত তাহলে এ সংকট অনেকাংশেই সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে পারতো।”—নিউইয়র্ক ভিত্তিক ইহুদি রাজনৈতিক বিজ্ঞানী নরম্যান ফিঙ্কেলস্টেইন
২০০৫ সালে ইসরায়েল ভূমি, বায়ু এবং জল অবরোধ কার্যকর করার পর থেকে বিদেশী দখলদাররা জমির আসল মালিকদের খাঁচায় বন্দী করেছে। ফিলিস্তিনিরা আটকা পড়েছে ৩৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি ঘনবসতিপূর্ণ নরক-গহবরে। দখলদার ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর অনুমতি ছাড়া কেউ বাইরে যেতে বা প্রবেশ করতে পারে না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গাজাবাসী তাদের জীবন এবং তাদের সন্তানদের জীবনসহ আটকা পড়েছে এ উন্মুক্ত জেলখানায়। যেখানে বেঁচে থাকা তো দূরের কথা, স্বাভাবিক মৃত্যুরও ন্যূনতম নিশ্চয়তাটুকু নেই।
ফিলিস্তিনের ভূ-খন্ডে দীর্ঘকাল ধরে চলমান এ যুদ্ধ এবং গণহত্যার জন্য প্রকৃতপক্ষে কারা দোষী, তা লেখা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টির সময়ই। মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতো, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীও নিরবিচ্ছিন্নভাবে ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে যে কোনো প্রকারের নির্যাতন, নিপীড়ন, গালাগাল, অপমান এমনকি হত্যা পর্যন্ত করতে পারে কোনো প্রতিবন্ধকতা ও জবাবদিহিতা ছাড়াই। আশ্রয় প্রত্যাশী বিদেশী ইহুদিদের জায়গা করে দিতে ইসরায়েলিরা ইচ্ছামত ফিলিস্তিনের লোকদের উচ্ছেদ করতে পারে এবং যত্রতত্র ঘরবাড়ি, খামার, জলপথ, হাসপাতাল, স্কুল, উপাসনালয় গুড়িয়ে দিতে পারে। এর জন্য তাদের কাউকে কোনো দেশীয় বা আন্তর্জাতিক আইনি বা বিচারিক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয় না।
আরু পড়ুন: আমাদের শিক্ষাগুরু সৈয়দ ইরফানুল বারী
আল-জাজিরার একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ফিলিস্তিনের জন্য ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের আগে, ফিলিস্তিনে ইহুদিরা ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬ শতাংশ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত, নাকবা বা “মহা বিপর্যয়ের” সময়, ইহুদিবাদী সামরিক বাহিনী কমপক্ষে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে বহিষ্কার করে এবং ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের ৭৮ শতাংশ জমি দখল করে নেয়। অবশিষ্ট ২২ শতাংশ পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় বিভক্ত ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময়, ইসরায়েলি বাহিনী সমস্ত ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন দখল করে এবং আরও ৩০ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর থেকে উৎখাত করে। আজও চালু আছে এবং সম্প্রসারিত হচ্ছে তাদের এ দখলদারিত্ব। এখনো ইসরায়েল জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর এবং জমি থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ইহুদি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা দখল করে নিচ্ছে আরবদের বসতভিটা। সুতরাং, জোরপূর্বক দখলদার ও জায়নবাদী রাষ্ট্রের কাছ থেকে ফিলিস্তিনিদের পৈতৃক ভূমি ফিরিয়ে নিতে সংগ্রাম করা অবশ্যই অপরাধ নয়।
চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মূল কারণ খুঁজতে গেলে আরো পেছনের দিকে যেতে হবে আমাদেরকে। এ সংঘাতের বীজ রোপণ করেছিল মূলত ব্রিটিশরা। যখন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আর্থার বেলফোর ২রা নভেম্বর, ১৯১৭ সালে ইহুদিবাদী নেতা লর্ড রথচাইল্ডকে ফিলিস্তিনের প্রাণকেন্দ্রে একটি ইহুদি স্বদেশ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিশ্চিত করে চিঠি লিখেছিলেন, সেই দিনই শুরু হয়েছিল জাতিগত এ সংঘাতের অশুভ সূচনা।
ব্রিটিশদের এ ধরণের কুকর্ম নতুন নয়। কাশ্মীর নিয়েও ঠিক একই খেলা খেলেছে তারা। পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরের ভূমিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি বিতর্কিত হটস্পট হিসেবে রাখতে ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারতকেও ভাগ করেছে একই কায়দায়। কাশ্মীর এখনো লটকে আছে উভয় দেশের মাঝখানে। দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই করছে কাশ্মীরের জনগণ। একইভাবে আয়ারল্যান্ডের উত্তর এবং দক্ষিণ দুই অংশের মধ্যে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্তও করেছিল ব্রিটিশরাই। তাদের সেই অশুভ কাজের ফলই আজকের ইসরায়েলের চলমান ধ্বংসযজ্ঞ। এসব অপকর্মের দায়িত্ব ব্রিটিশরা এড়াতে পারে না।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন কার বেশি আত্মরক্ষার অধিকার দরকার, ইসরাইল না ফিলিস্তিন? ইসরায়েলের রক্ষক এবং প্রবর্তক হয়ে বিশ্ব শক্তিগুলো বিগত ৭০ বছর ধরে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত সমাধানের ভান করে হানাদার ও দখলদারকে আকুণ্ঠ সমর্থন জুগিয়ে নিজেদের আসল চেহারা দেখিয়েছে। কেউ যদি আশা করে যে, ইউরোপ-আমেরিকার তথাকথিত মানবতাবাদের ধ্বজাধারী বলে নিজেদের প্রচারকারী দেশগুলো এ সংঘাতের সমাধান করবে, তবে সে বোকার স্বর্গে বাস করছে।
আরও পড়ুন: সেই ভাইভার পর বুঝে গিয়েছিলাম কাদের হাতে উচ্চশিক্ষা জিম্মি
বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, স্বাধীকার আন্দোলনের অন্যতম চ্যাম্পিয়ন এবং রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ইসরাইলকে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র বলে অভিহিত করেছেন। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধে আরেক দক্ষিণ আফ্রিকান যোদ্ধা, অতি সম্মানিত খ্রিস্টান ধর্মগুরু, আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু, ইসরায়েলের বর্ণবাদ দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়েও খারাপ বলে অভিহিত করেছেন। এ দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী হামাস হলো ভূমি, মর্যাদা এবং জাতীয়তা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি প্রতিরোধ শক্তি। ফিলিস্তিনের ভূমি ও অধিকার রক্ষায় সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তারা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে। বিশ্বের স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্রতিটি মানুষ তাদের পক্ষে আছে এবং থাকবে।
দখলকৃত ফিলিস্তিনে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বৈষম্য, নির্যাতন, ধ্বংস, উচ্ছেদ, অপমান ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে বর্ণবাদী ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী। তবে দুঃখের বিষয় হলো, ইহুদিবাদী রাষ্ট্র সৃষ্টির পেছনের পরাশক্তি এবং ইসরায়েলপন্থী মিডিয়া ফিলিস্তিনি আরব, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের উপর প্রতিদিনের নৃশংসতা, নির্যাতন, অপমানজনক বৈষম্য যেন দেখতেই পায় না। ইচ্ছাকৃতভাবে এ সমস্ত হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের খবর তারা আড়াল করে চলেছে চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে। অত্যন্ত সম্মানিত অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘৬০ মিনিট শো এর উপস্থাপক রিচার্ড কার্লটনকে অধিকৃত অঞ্চলে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী কেমন করে চূড়ান্ত হেনস্তা করেছিল এবং তার অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট মাটিতে ফেলে দিয়েছিল, তা দেখেছে বিশ্ব। তবে এ জন্য কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি।
কারণ বর্ণবাদী রাষ্ট্রের পক্ষে মানুষের সাথে তাদের ইচ্ছা মতো আচরণ করা স্বাভাবিক। এটাই যেন তাদের অধিকার। কোন জবাবদিহিতা, কোন সম্মান, কোন আইনি পরিণতি কিচ্ছু নেই তাদের ক্ষেত্রে। সহজেই অনুমান করা যায়, ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত একজন অত্যন্ত সম্মানিত অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকের ক্ষেত্রে যদি এমনটা ঘটতে পারে, তাহলে ইহুদীবাদীদের করুণায় বেঁচে থাকা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত অবস্থাটা আসলে কী!
১৯৪৬ সালের ২২ জুলাই ইহুদিবাদী আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন, ইরগুন জেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলের অবস্থিত ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অফিসে বোমা হামলা করে। যেখানে ৯১ জন নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিল আরব এবং ব্রিটিশ। আহত হয় ৪৬ জন। একই গোষ্ঠী ফিলিস্তিনি জনগণ এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ৬০ টিরও বেশি হামলা চালিয়েছে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য কাউকে কখনও অভিযুক্ত করা হয়নি। যেহেতু তারা জায়নবাদী, সুতরাং তারা সন্ত্রাসী নয়! এই হলো তাদের দোসর পরাশক্তির দৃষ্টিভঙ্গি।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক ইহুদি রাজনৈতিক বিজ্ঞানী নরম্যান ফিঙ্কেলস্টেইন বলেছেন, “ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাপ্তি সহজ: ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেবল আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করতে হবে।” দুর্ভাগ্যবশত, ইসরায়েল যেকোনো আইন ও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। নরম্যান ফিঙ্কেলস্টেইন বলেন, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর আগ্রাসন চালিয়েছে। তিনি আরও বলেন, “ইসরায়েল যদি ২০০৬ সালের জানুয়ারির ফিলিস্তিনি নির্বাচনের ফলাফলকে অনুমতি দিত, বিজয়ীদের শাসনের অনুমতি দিত এবং গাজা বন্ধ না করত তাহলে এ সংকট অনেকাংশেই সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে পারতো। কারণ উক্ত নির্বাচনে মানুষ হামাসের পক্ষে জনসমর্থন দিয়েছিল। এতে একটি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ সেখানে আসতে পারতো। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারও নির্বাচনকে সম্পূর্ণ সুষ্ঠু ও অবাধ বলেছিলেন। কিন্তু ইসরায়েল এবং তার মিত্ররা চায় নি যে কোনো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত গোষ্ঠী গাজা পরিচালনা করুক, যদিও নির্বাচনে হামাসের ৭ জন অমুসলিম প্রার্থীও ছিলেন। তারা নিজ দেশে গণতন্ত্র চর্চা করলেও ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে চরম বিরোধীতা করে নিজেদের মুখোশ উন্মোচিত করেছে।
যখনই ইসরায়েলের বর্ণবাদী রাষ্ট্র রাজনৈতিক কারণে বা তাদের হিংসাত্মক কাজের জন্য সমালোচিত হয়, তখন ইহুদিবাদী লবি দ্রুত একে ইহুদি-বিরোধীতা বলে অভিহিত করে। যদিও ইহুদি জনগণের প্রতি আরবদের কোনো শত্রুতা নেই। ব্যক্তি ইহুদি আর ইসরায়েলের ইহুদীবাদী নীতি এক কথা নয়। একটা মানুষের ধর্ম বিশ্বাস, আরেকটা বর্ণবাদী শোষণ ও নীপিড়নের হাতিয়ার। অনেক সাধারণ ইহুদীরা পর্যন্ত ইসরায়েলের ইহুদীবাদী আচরণের সমালোচনা করে। তারা সর্বদা ইহুদি রাষ্ট্র, জনগণের বৈধতা এবং সত্য নির্বিশেষে যেকোনো বৈধ সমালোচনার মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। পরিহাসের বিষয় হল, জার্মানিতে হিটলার যেভাবে ইহুদিদের সাথে আচরণ করেছিলেন, ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনের জনগণের সাথে তার চেয়ে অনেক খারাপ আচরণ করে চলেছে। ইতিহাসের চাকা যে আবার ঘুরতে পারে, তা ওদের জানা থাকার কথা।
ইসরায়েলের শাসকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে তারা আরব, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের চেয়ে উচ্চতর জাতের মানুষ। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক, শারীরিকভাবে ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য অ-ইহুদিদের চেয়ে অনেক ভালো। এই উচ্চতর মর্যাদাবোধ থেকে তারা গাজার জনগণের ওপর নৃশংসতা চালাতে দ্বিধা করে না। কোনো রকম ঔচিত্যবোধের ধার না ধেরে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতেও কুণ্ঠিত হয় না। একই ধরনের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিকে ‘শুধুমাত্র সাদা অভিবাসন’ নীতি অনুশীলন করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
ইহুদিবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডোর হার্জলের স্বপ্ন ছিল “বৃহত্তর ইসরায়েল” প্রতিষ্ঠা করা। যার সীমানা হবে মিশরের ব্রুক থেকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই লক্ষ্যেই ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সীমানা সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেছে তারা। গাজা দখলের যুদ্ধের মাধ্যমে বেগবান হয়েছে যার যাত্রা। গাজা মূলত তাদের সম্প্রসারণবাদের শুরু। এখানে সফল হলে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী শীঘ্রই ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ তৈরি করতে অন্যান্য প্রতিবেশী আরব রাজ্যেও থাবা বসাবে। সুতরাং বিশ্ববাসীকে সচেতন হতে হবে এখনই। বিশ্বকে অবশ্যই একটি নতুন সত্যের সাথে পরিচিত হতে হবে যে, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কোনো মানুষের নিহত হওয়ার আইনগত অধিকার নেই।
যদি কেউ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ, ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ নিয়ে সোচ্চার হয়, তবে প্রথমে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীকারের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে হবে। ২০০৬ সালে হামাসের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে গাজা শাসন করার অনুমতি না দেওয়া একটি বড় ভুল ছিল।
অসহায় শিশু, নারী-পুরুষসহ নিরীহ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের জীবন বিপন্ন হওয়া থেকে বাঁচাতে উদ্যোগ নেওয়ার এখনই সময়। যদিও ইতিমেধ্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। বহু প্রাণ ঝরে গেছে, বহু রক্ত প্রবাহিত হয়েছে। তবুও সব ধরনের যুদ্ধ ও সংঘাত বন্ধ করে উভয় পক্ষকেই তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার সময়ও এখনই। ইসরায়েলকে থামাতে হবে ধ্বংস যজ্ঞ চালানো থেকে। একইসাথে মানবাধিকারের কথা শুধু মুখে না বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও পালন করতে হবে প্রকৃত মানবতাবাদীর ভূমিকা।
ইসরায়েলকে সামরিক খাতে সহায়তা ও সমর্থন করা বন্ধ করতে হবে। তারা যদি তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের জনগণের রক্ত ব্যবহার বন্ধ করে এবং তাদের প্রাণঘাতী অস্ত্র পরীক্ষা অব্যাহত না রাখে, এবং একইসাথে আরব রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে এই অঞ্চলে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার না করে, তাহলেই বসবাসের উপযোগী থাকবে বিশ্ব। নইলে এ রক্তের স্রোত থামবে না। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও শান্তিই উদ্ভূত সংকট সমাধানের একমাত্র পূর্বশর্ত।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
উপাচার্য, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
ইংরেজি থেকে ভাবানুবাদ: রবিউল করিম মৃদুল