মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস
খুলনা মেডিকেলের ১১ শিক্ষার্থীর তথ্য সিআইডিতে
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৩, ০৬:১১ PM , আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২৩, ০৬:১১ PM
খুলনা মেডিকেল কলেজে (খুমেক) লেখাপড়া করেছে এমন ১১ জন শিক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক তথ্য নিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তথ্য নেয়ার পর ওই ১১ জনের মধ্য থেকে ইতোমধ্যে ৩ জন শিক্ষার্থী আটকও করেছে সিআইডি। এরা সবাই প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠান খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং থেকে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, গত প্রায় দেড় মাস আগে সিআইডি থেকে অধ্যক্ষকে চিঠি দেয়া হয়। তাতে ২০১৫ সালে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খুমেকে ভর্তি হয়েছে, এমন ১১ শিক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক তথ্য চাওয়া হয়। গত ১৬ জুলাই অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে ওই ১১ শিক্ষার্থীর তথ্য সিআইডিকে দেয়া হয়।
১১ জনের মধ্যে শুক্রবার দুপুরে ৩ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। তারা হলেন- শার্মিষ্ঠা মণ্ডল, নাজিয়া মেহজাবিন তিশা ও মুস্তাহিন হাসান লামিয়া। এরা তিনজনই এমবিবিএস উত্তীর্ণ হয়েছেন। নাজিয়া মেহজাবিন তিশা ইতোমধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উচ্চতর ডিগ্রি এফসিপিএস-এর প্রথম ধাপ উত্তীর্ণ হয়েছেন।
সিআইডির চাহিদার প্রেক্ষিতে আমরা তাদের তথ্য প্রদান করেছি। ওইসব শিক্ষার্থীরা যদি ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে এখানে ভর্তি হন, তাহলে রাষ্ট্রীয় আইন মোতাবেক তাদের শাস্তি হোক—অধ্যাপক ডা. মো. দীন-উল-ইসলাম, অধ্যক্ষ, খুলনা মেডিকেল কলেজে।
এছাড়া বাকি ৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩ জন এখনো এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ৩ জনের মধ্যে ২ জন শেষ বর্ষের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে, তবে ফলাফল এখনও প্রকাশ হয়নি। বাকি একজন এখনও শেষ বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিতে পরেননি।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে খুমেকের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, বিগত ২০১৫ সালে যেসব শিক্ষার্থীরা খুমেকে ভর্তি হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকের মেডিক্যালে পড়ার নূন্যতম যোগ্যতাও ছিল না। ওই ব্যাচে খুলনা মেডিক্যালে এমন ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন, যারা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পাশ করেছেন।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. দীন-উল-ইসলাম জানান, সিআইডির চাহিদার প্রেক্ষিতে আমরা তাদের তথ্য প্রদান করেছি। ওইসব শিক্ষার্থীরা যদি ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে এখানে ভর্তি হন, তাহলে রাষ্ট্রীয় আইন মোতাবেক তাদের শাস্তি হোক।
অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠান খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং থেকে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিল। ওই কোচিং সেন্টারটির উপদেষ্টা ডা. ইউনুস খান তারিমকেও শুক্রবার দুপুরে খুলনা থেকে আটক করেছে সিআইডি।
ডা. তারিমও খুলনা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় খুমেক শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে খুমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) খুলনা জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) খুলনা জেলা শাখার সদস্য।
অভিযুক্তদের আটক করেছে সিআইডি
সম্প্রতি সিআইডি প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ৭ জনই চিকিৎসক। তদন্তের ধারাবাহিকতায় খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. তারিমকে আটক করা হয়েছে। এর আগে গত ১৩ আগস্ট সিআইডি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল দেশে বিগত ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ বছরে ১০ বার মেডিকেল ভর্তির প্রশ্নফাঁস করেছে একটি চক্র। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তির কোচিং সেন্টারের আড়ালে প্রশ্নফাঁসের কারবার চালিয়ে আসছিলেন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বলছে, প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে চক্রটি প্রতি বছর গড়ে ১৫০ জনের মতো শিক্ষার্থীকে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছে। অর্থাৎ দেশে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে বিগত ১৬ বছরে দেড় হাজার ডাক্তারেরও বেশি চিকিৎসক বের হয়েছেন। যারা বর্তমানে চিকিৎসা সেবার সাথে যুক্ত রয়েছেন। তবে, প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পাওয়ার কথা জানিয়েছে সিআইডি।
চক্রের ৮০ জন সক্রিয় সদস্য দেশে বিগত ১৬ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিকেল কলেজগুলোয় ভর্তি করার মাধ্যমে শত কোটি টাকা আয় করেছে। প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পেয়েছে সিআইডি। এরমধ্যে অনেকে পাশ করে ডাক্তারও হয়েছেন—মোহাম্মদ আলী মিয়া, সিআইডি প্রধান ।
সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিগত ২০২০ সালের প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তে নেমে সিআইডি প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মূল হোতা জসীম উদ্দীন ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রেসের মেশিনম্যান জসিমের খালাত ভাই মোহাম্মদ সালামকে গ্রেপ্তার করে। আদালতে তাদের দেওয়া ৬৪ ধারার জবানবন্দিতে এই চক্রের ১২ জনের নাম আসে। দীর্ঘ দিন তারা পলাতক ছিলেন। অবশেষে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন মেডিকেল ভর্তির প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড ডাক্তার ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান। তিনি ফাইন কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। তিনি গত ১৭ বছরে শত শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার স্ত্রী জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ডাক্তার সোহেলী জামানও এই চক্রের সদস্য।
এছাড়াও এ চক্রের অন্যতম সদস্য ডাক্তার আবু রায়হান, ডাক্তার জেডএম সালেহীন শোভন, ডা. জোবাইদুর রহমান জনি, জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের (নিটোর) চিকিৎসক জিল্লুর হাসান রনি, ডা. ইমরুল কায়েস হিমেল। এছাড়া জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার, রওশন আলী হিমু, আক্তারুজ্জামান তুষার, জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী ও আব্দুল কুদ্দুস সরকার।
এ ঘটনায় নাম এসেছে মেডিকো ভর্তি কোচিং, ই-হক কোচিং সেন্টার, ফেইম কোচিং, প্রাইভেট কোচিং সেন্টার, থ্রি-ডক্টরস কোচিং সেন্টার, ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল নামের একটি ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র এবং প্রাইমেট নামের একটি ভর্তি কোচিংয়ের নাম। সিআইডি জানিয়েছে, মেডিকেল ভর্তি কোচিংয়ের আড়ালে নানা সময়ে এসব প্রশ্ন ফাঁস করেছে চক্রটি।
সিআইডর সংবাদ সম্মেলন
সিআইডির প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল সংখ্যক ব্যাংকের চেক, প্রবেশপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। চক্রের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এরা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে কোনো অপরাধ করেছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।
এর আগে বিগত ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করেছে। গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল সংখ্যক ব্যাংকের চেক এবং এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়রি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের নাম রয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলেও জানান সিআইডি প্রধান।