বিএনএফ মহাসচিব অধ্যক্ষ নজরুলের বিরুদ্ধে অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৯ PM , আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:২৭ PM
বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) মহাসচিব ও রাজধানীর মহাখালী দারুল উলুম হোসাইনিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ড. নজরুল ইসলাম আল-মারুফের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে সম্প্রতি ঢাকা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
২০১৩ সালে ওই মাদরাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান নজরুল ইসলাম আল-মারুফ। তাঁর দলের সভাপতি আবুল কালাম আযাদ ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে ঢাকা-১৭ (গুলশান–বনানী) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর মাদরাসার গভর্নিং বডির সভাপতি হন। সে সময় স্থানীয়ভাবে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি জায়েদুল হককে সভাপতি পদ থেকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়।
জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত ঐতিহ্যবাহী মাদরাসাটি তখন ছাত্রছাত্রীতে পরিপূর্ণ ছিল এবং ফলাফলেও ছিল সুনাম। তবে সভাপতি ও অধ্যক্ষ পরিবর্তনের পর প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ–বাণিজ্য, তহবিল তসরুপ, সরকারি বিধান লঙ্ঘন—এমন কোনো অনিয়ম নেই, যা করা হয়নি। এসবের প্রতিবাদ করায় মেধাবী ছাত্রদের ‘শিবির ট্যাগ’ দিয়ে হোস্টেল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এতে আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিনে দিনে প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: ‘জবাবদিহির আওতায় আসছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদরাসার প্রায় সব কার্যক্রমই এখন অধ্যক্ষের একক সিদ্ধান্তে পরিচালিত হচ্ছে। গভর্নিং বডিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে তিনি বাজেট প্রণয়ন, আয়–ব্যয়ের হিসাব, অডিট, ব্যাংকে অর্থ জমা, শিক্ষক–কর্মচারী নিয়োগ ও বহিষ্কার—কোনো ক্ষেত্রেই সরকারি বিধি বা কমিটির অনুমোদন অনুসরণ করেননি। ফলে প্রতিষ্ঠানটি কার্যত ধ্বংসের মুখে পড়েছে।
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও অধ্যক্ষ নজরুলের এসব অনিয়ম অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি অভিভাবক প্রতিনিধি, দাতা ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নির্বাচনে বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিতভাবে দেওয়া হলেও সেটি নিষ্পত্তির আগেই তিনি ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবিধান উপেক্ষা করে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন গভর্নিং বডি গঠন করেছেন এবং তা অনুমোদনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও প্রভাব
স্থানীয় বাসিন্দা ও অভিভাবক মাহমুদ হাসান আরিফ এ বিষয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হাসিনা সরকারের সময় বিএনপিকে বিভক্ত করার লক্ষ্যে বিএনএফ গঠিত হয়, যার প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলেন বর্তমান অধ্যক্ষ। তিনি এখনো সেই পদে থেকে রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে মাদরাসায় অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছেন।’
গভর্নিং বডি গঠনে অনিয়ম
অভিযোগে বলা হয়, অধ্যক্ষ গোপনে নিজের পছন্দমতো ব্যক্তিদের নিয়ে গভর্নিং বডি গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচনের তফসিল, ভোটার তালিকা বা কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। সভাপতির ক্ষেত্রে যোগ্যতা শিথিল করা হয়েছে এবং শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবিধান মানা হয়নি।
স্বেচ্ছাচারিতা ও ভয়ভীতি
অভিযোগকারীর দাবি, যারা জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন, তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ কিছু শিক্ষক, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মাদরাসার করণীক ফোরকান আহম্মেদ অভিযোগকারীদের হুমকি দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, অধ্যক্ষের ছত্রচ্ছায়ায় করণীক ফোরকান বেআইনিভাবে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক বলেন, ‘ফোরকানের বিরোধিতা করলে চাকরি থাকবে না।’ তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী পেটানো ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে।
আরও পড়ুন: ঢাবির বিখ্যাত কুকুর ‘অভ্র’, সোশ্যাল মিডিয়ায় যার আছে অ্যাকাউন্ট ও জনপ্রিয়তা
ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে করণীক ফোরকানের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অধ্যক্ষের প্রশাসনিক দুর্বলতা প্রমাণিত হলেও তৎকালীন গভর্নিং বডির সভাপতি আবুল কালাম আযাদের প্রভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
মাহমুদ হাসান আরিফ বলেন, ‘আমার সন্তান এখন অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে। বৈধ অভিভাবক না হলেও জনস্বার্থে অভিযোগ দিয়েছি। আশা করি, সুষ্ঠু তদন্ত শেষে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ অক্টোবর সহকারী কমিশনার নুসরাত নওশীন স্বাক্ষরিত নোটিশে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম আল-মারুফকে ৩ দিনের মধ্যে লিখিত জবাব দিতে বলা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে অধ্যক্ষ ড. নজরুল ইসলাম আল-মারুফের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় শুনে সংযোগ কেটে দেন। পরে আরো একাধিকবার তার নম্বরে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ বলেন, ‘মহাখালী দারুল উলুম হোসাইনিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ড. নজরুল ইসলাম আল-মারুফের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি। তার জবাব পেলে সেই অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এদিকে একই বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে ফাজিল ও কামিল মাদরাসাগুলোর তদারককারী প্রতিষ্ঠান ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযোগ তদন্তে দ্রুত একটি কমিটি গঠন করা হবে। তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’