ঢাবির বিখ্যাত কুকুর ‘অভ্র’, সোশ্যাল মিডিয়ায় যার আছে অ্যাকাউন্ট ও জনপ্রিয়তা
- রামিসা আনজুম, ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৮ PM , আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৩১ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২৫ অক্টোবরের ভোরটা ছিল অন্য সব দিনের মতোই শান্ত। ভিসি চত্বর তখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। গাছের পাতায় ভোরের বাতাস লেগে হালকা শব্দ তুলছে, পাখিরা ডানা ঝাপটে উঠছে আলোর খোঁজে। এমন সময় দূর থেকে একদল তরুণ দেখতে পেল এক পরিচিত চেহারা। গোলগাল, চোখ-মুখে রাজকীয় ভাব, হেঁটে যাচ্ছে একটু বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে। কাছে যেতেই চেনা পড়ল, আহা! এ যে তাদের প্রিয় ‘অভ্র’।
ঢাবির টিএসসির সেই নামকরা কুকুরের নাম অভ্র। ক্যাম্পাসের প্রায় সবারই চেনা মুখ। ওকে যারা দেখেছে, তারা জানে, অভ্র কিন্তু কোনো সাধারণ কুকুর নয়। ও যেন পুরো ক্যাম্পাসেরই ‘আলফা ডগ’। অভ্র প্রভাবশালী, আত্মসম্মানী এবং একদম নিজস্ব চরিত্রের অধিকারী এক আশ্চর্য প্রাণী।
সেদিন ভোরে অভ্র পথ হারিয়ে টিএসসি থেকে চলে এসেছিল ভিসি চত্বরে। শিক্ষার্থী কারীব চৌধুরী জানান, ‘অভ্র বেচারা খুব বিচলিত ছিল, কোথায় যাবে বুঝতে পারছিল না। আমরা তখন একটা রিকশা ডেকে বললাম, ‘অভ্র, রিকশা এসেছে—ওঠো।’ অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হলো, সে পা দুটো মেলে রিকশায় উঠল! তারপর আমরা রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘টিএসসি নামিয়ে দিও।’ অভ্র রাজকীয় ভঙ্গিতে রিকশায় চেপে বসল, যেন ঢাবির কোনো শিক্ষার্থী যাচ্ছেন তার বিভাগে!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভ্র শুধু একটা কুকুর নয়, সে অনেক ছাত্রছাত্রীর বন্ধু, সহচর, কখনো হয়তো মানসিক সাপোর্টও। টিএসসির চা-চক্র, গান-বাজনা, মিছিল ইত্যাদি সব জায়গাতেই অভ্রর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। অনেকে মজা করে বলে, ‘অভ্র মানুষের ভাষা বোঝে, শুধু উত্তর দেয় না!’
অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অব ঢাকা ইউনিভার্সিটির সদস্য মিশকাতুল মাশিয়াত জানান, ‘২০১৭ সাল থেকে অভ্র ক্যাম্পাসে আছে। ছোটবেলায় ও একদম চিকন ছিল। এখন মানুষের ভালোবাসা আর প্রতিদিনের বিস্কুট-চিপস খেয়ে ওজন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৬ কেজি!’
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের সময় টিএসসির অনেক কুকুরই ছাত্রদের সঙ্গে ছিল। মিছিল বের হলে ওরাও পাশে পাশে হাঁটত। এমনকি বঙ্গভবনে স্মারকলিপি দেওয়ার দিনও অভ্র গিয়েছিল। কিন্তু টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেডের আওয়াজে ওরা খুব ভয় পেয়েছিল, অনেক দিন ট্রমায় ছিল।’
মিশকাতুল আরও বলেন, ‘আমাদের অনুরোধ, অভ্রকে যেন কেক, বিস্কুট এসব না দেওয়া হয়। ও স্থূলতায় ভুগছে। আর কিছু মানুষ অভ্রকে ভয় দেখালে বা তাড়া দিলে সে উত্তেজিত হয়। বিশেষ করে লুঙ্গি পরা বা বস্তাওয়ালা মানুষ দেখলে। সম্ভবত অতীতে এমন মানুষের কাছ থেকেই হয়তো ও নির্যাতিত হয়েছিল।’
ঢাবির টিএসসিতে এখন অভ্রর পাশাপাশি আরও তিনজন ‘ক্যাম্পাস তারকা’ আছে। তাদের নাম ‘সুন্দরী’, ‘পেরো’, আর ‘ল্যাংড়া’। এই চার বন্ধু এখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার, অভ্রর এখন নিজস্ব ফেসবুক আইডিও আছে! সেখানে দুই হাজারেরও বেশি অনুসারী, নিয়মিত পোস্ট, ছবি আর শিক্ষার্থীদের স্নেহের বার্তা। কেউ লেখে, ‘আজ অভ্রর সঙ্গে দেখা হলো,’ কেউ আবার দেয় ‘ফ্যান মিট’ আপডেট!
ঢাবি শিক্ষার্থীদের আনন্দ-বেদনা, প্রতিবাদ, বিশ্রাম যেন সবকিছুরই নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই কুকুরগুলো। টিএসসির বেঞ্চে বসে চায়ের কাপের পাশে ওরা থাকে, আন্দোলনের মিছিলে লেজ নাড়ায়, আবার শান্ত সন্ধ্যায় ভিসি চত্বরে ঘাসের ওপর শুয়ে থাকে নিঃশব্দ অভ্র।
অভ্র ও তার সঙ্গীরা এখন শুধু কুকুর নয়, যেন তারা মানবতা, সহানুভূতি, এবং এক প্রাকৃতিক বন্ধুত্বের জীবন্ত প্রতীক। হয়তো একদিন ঢাবির ইতিহাসে একটা অধ্যায় লেখা হবে ‘যেখানে মানুষ লড়েছিল, সেখানে কুকুররাও পাশে ছিল।’