বাবার স্বপ্নই আমার সাহস, সফল হওয়ার অনুপ্রেরণা

মনিরা
মনিরা  © টিডিসি ফটো

এ বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় চমক দেখিয়েছেন  বরিশালের আলহাজ্ব জালাল উদ্দীন ডিগ্রী কলেজের মনিরা। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি ইউনিটে ১১০, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ইউনিট প্রথম শিফটে ৫৪ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সি ইউনিটে ২য় স্থান অর্জন করেছেন তিনি।

ভর্তি প্রস্তুতি ও পরীক্ষা চলাকালীন সময়ের বিভিন্ন গল্প নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছেন এই ছাত্রী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ প্রতিনিধি জুনাইদ সিদ্দিকী—

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এসএসসি-এইচএসসি কোথা থেকে শেষ করেছেন? মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের গল্পগুলো শুনতে চাই।

মনিরা: পড়াশোনায় আমার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই। আর রেজাল্ট ভালো হওয়ায় বাবা আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। সবার মত আমারও ইচ্ছে ছিলো অষ্টম শ্রেণীতে পরীক্ষা দিয়ে শহরের নামি-দামি কোনো স্কুলে ভর্তি হব। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়ে এবং বাবা অসুস্থ ও ফ্যামিলিতে আর্থিক সমস্যা থাকায় নামি-দামি কোনো স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ হয়নি। মাধ্যমিক শেষ করি আমার গ্রামের পাশের গ্রামেই চর-চাপলি ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এবং উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করি নিজ গ্রামেই আলহাজ্ব জালাল উদ্দিন ডিগ্রী কলেজ থেকে।  

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ভর্তি পরীক্ষার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?

মনিরা: ইন্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরেই ঢাকায় বান্ধবীর সঙ্গে একটা কোচিংয়ে  ভর্তি হয়ে নিয়মিত ক্লাস শুরু করে দিয়েছি। নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল- আমি পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাব। এজন্য যত পরিশ্রম করা দরকার, আমি করব। প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করতাম। স্যারদের নির্দেশ মতো পড়তাম। কোচিংয়ের পরীক্ষায় ভালো করার চেষ্টা করতাম। দেখতে দেখতে স্বপ্নের সিঁড়ি পার হওয়ার সময় চলে আসলো। সর্বশেষ বাবার মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি; এটাই অনেক আমার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ ।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দিনে কত সময় পড়াশোনা করতেন?

আমি প্রতিদিন পড়ার জন্য নির্ধারিত একটা রুটিন করতাম যে, এগুলো আমাকে শেষ করতে হবে। প্রতিদিন ৯-১০ ঘণ্টা পড়তাম। আসলে পরীক্ষার টেনশনে আবেগ-আপ্লুত হয়ে সারাদিন-রাত পড়াশোনা করা, কিছু বাকি থাকলে তা অন্য এক সময় পড়বো এমন মানসিকতা ত্যাগ করে প্রতিনিয়ত পরিকল্পিতভাবে পড়াশোনার মাধ্যমে কঠিনকে সহজ করাই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার সহজ টেকনিক।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার অনুপ্রেরণা কে ছিল?

মনিরা: বাবার স্বপ্নই আমার অনুপ্রেরণা। ছোটবেলায় বাবা বলতো আমার মেয়েকে ব্যারিস্টার বানাব। তখন থেকে আমার মাথায় ঢুকে যায়, আমাকে আইন নিয়ে পড়তে হবে। প্রতিনিয়ত বাবার এই স্বপ্ন আমাকে সাহস যোগায়, জীবনে সফল হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার জীবনে এমন কোনো সংগ্রামের গল্প আছে কি-না? যেটা এখন বলতে চান

মনিরা: হ্যাঁ, প্রত্যেকের মতো আমারও এই সফলতার পেছনে দুঃখময় স্মৃতি আছে; কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল পেয়ে গেলে এগুলো মনে করার জন্য আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না। কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে আমরা কলেজে ভর্তি হই, কোভিড-১৯ এর জন্য ঠিকমত ক্লাস হতো না, পরীক্ষা নাই, প্রতিযোগী নাই, নানা কারনে পড়াশোনায় পিছিয়ে যাই। পরীক্ষার বাকি আর তিন মাস। সিলেবাস ২০ ভাগ ও শেষ হয়াস। তখন এডমিশনের কথা শুনলাম একটু একটু।

সিলেবাস-ই শেষ হয়নি; এর মধ্যে ৪ মাসে এডমিশনের প্রস্তুতি কীভাবে নেব? আমার সঙ্গে যারা ছিল তারা ঢাকায় পড়ত, ওদের পরীক্ষার প্রস্তুতি খুব ভালো ছিল। আগে থেকে এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি নিজের অবস্থান ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। খারাপ রেজাল্ট করলে বাবার এতদিনের স্বপ্নের ভরসা শেষ হয়ে যাবে। আমাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে এই ভেবে তিন মাস সর্বোচ্চ চেষ্টা  চালিয়ে আলহামদুলিল্লাহ উচ্চ-মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়েছিলাম।

চুয়েট কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাননি ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী

এরপর ঢাকায় কোচিং শুরু করি। নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল আমাকে ঢাবিয়ান হতে যত পরিশ্রম করার দরকার আমাকে করতে হবে। কোচিং এ ভালো করতাম। সবার বিশ্বাস ছিল আমি টপ করব। কোচিং শেষ পরীক্ষা দিতে দিতে পড়ার সময় হতো না। পড়া গুছিয়ে নেবার সময় আসলো আর আমি তখনই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। পরীক্ষার বাকি আর ১৫ দিন! ভাগ্য আমার সহায় ছিল না। পরীক্ষা দিয়ে হতাশ। আমার সব কষ্ট বুঝি বৃথা হয়ে গেল। কৃতজ্ঞতা জানাই আমার বান্ধবীকে। ও পাশে না থাকলে হয়তো সেদিনই ভেঙে পড়তাম। আজ এই সফলতার মুখটা আর দেখা হতো না। বারবার আমাকে সাহস জুগিয়েছে এই বলে যে, ‘ঢাবিতে হবে না তো কি হইছে, এখনো সময় আছে তুই পারবি ভালো কিছু করতে।’

এরপর এক এক করে বাকি চবি, গুচ্ছ, রাবি, জাবির পরীক্ষা দিলাম। ঢাবিতে সিরিয়াল শেষের দিকে। আলহামদুলিল্লাহ বাকি সবগুলোতে ভালো পজিশন করলাম। চবিতে ডি ইউনিটে মেরিন পজিশন ১১০তম  আসে । রাবিতে এ ইউনিটে প্রথম শিফটে ৫৪তম আসে এবং জাবিতে সি ইউনিটে ২য় স্থান আসে। জাবিতে সেকেন্ড হওয়াতে আমার টাইমলাইন কংগ্রাচুলেশনস, দোয়া, ভালোবাসায় ভর্তি। ভাবতেও পারিনি এত ভালোবাসা পাব। সবাইকে খুশি দেখে বাবাও আজ আমাকে নিয়ে গর্ব করার সুযোগ পেয়েছে। বাবার মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি এটাই অনেক আমার জন্য। সর্বশেষ আলহামদুলিল্লাহ।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: জুনিয়রদের জন্য কিছু বলতে চান?

বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার জন্য কীভাবে পড়েছি এখন সেটার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না দিতে পারলেও এতোটুকু বলতে পারি জীবনে কোনো কাজ-ই খুব কঠিন কিংবা খুব সহজ নয়। কাজ যেমনই হোক সেটাকে নিজের মতো সহজ করে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে হবে। যার ফলে কাঙ্ক্ষিত সেই স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায় প্রতিদিন অন্তত ১২ ঘণ্টা পড়েছি। প্রতিদিনের নির্ধারিত পড়া প্রতিদিন শেষ করে তবেই ঘুমাতাম, নির্ধারিত কোনো রুটিনে নয়।

মনিরা: দেশের অন্যতম একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের একটা জায়গা করে নেয়ার স্বপ্ন দেখেছি প্রতিনিয়ত। যে স্বপ্ন আমাকে ঘুমাতে দেয়নি। ছোট্ট এই জীবনের অভিজ্ঞতায় এতোটুকু বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই ধৈর্য ধরে পরিকল্পনা অনুযায়ী লক্ষ্য স্থির রাখতে হবে। এটা সবসময় মাথায় রাখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় বাদ দেওয়ার জন্য। সুতরাং কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক; তা নির্ধারণ করে বিগত বছরের প্রশ্নপত্র দেখে সিলেবাস শেষ করা।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী:

মনিরা: আমার ফ্যামিলিতে ’ল’ ব্যাকগ্রাউন্ডের কেউ নেই। ছোটবেলা থেকে আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করাই আমার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণে আইন নিয়ে পড়তে চাই। আমারও ইচ্ছা, যেন বাবার স্বপ্নটা পূরণ করতে পারি। আর যতটুকু পারব আমার জায়গা থেকে মানুষকে সাহায্য করব। আমার দেশে যেন সবাই ভালোভাবে থাকতে পারেন। রাস্তাঘাটে বের হলে অনেক অসহায় মানুষকে দেখলে আসলে খারাপ লাগে। এদের জন্য কিছু করার ইচ্ছে আছে।


সর্বশেষ সংবাদ