হৃদ্রোগ-হাড় ক্ষয়ের নীরব ঘাতক লবণ, কাঁচা লবণে কি ঝুঁকি আরও বেশি?
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ০৭:৩৭ PM , আপডেট: ২৭ মে ২০২৫, ০৬:৫৫ PM
লবণ রান্নাঘরের সবচেয়ে পরিচিত ও অপরিহার্য উপাদান। এক চিমটি লবণ ছাড়া যেন খাবারে স্বাদই নেই! তবে এই স্বাদের খেলায় অনেক সময় লুকিয়ে থাকে স্বাস্থ্যহানির ভয়াবহ সম্ভাবনা। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বারবার সতর্ক করছে: ‘স্বাদে না, পরিমিতিতে বাঁচে সুস্থতা।’
অতিরিক্ত লবণের বিপদ
বিশ্বব্যাপী নানা গবেষণায় উঠে এসেছে, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। ‘দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই হৃদরোগজনিত মৃত্যুর অন্তত ১০ শতাংশের পেছনে দায়ী অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ।
মিরপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট পুষ্টিবিদ শরীফা আক্তার শাম্মী জানালেন, একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন লবণের সীমা ৫-৬ গ্রাম, অর্থাৎ এক চা চামচ। কিন্তু বাস্তবে এই পরিমাণ অনেক সময় দ্বিগুণ বা তারও বেশি হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: টি ব্যাগের যত জাদু: জানলে আর ফেলে দিতে পারবেন না
শরীরে কি ঘটে অতিরিক্ত লবণ খেলে
পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকদের মতে, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব ফেলে। নিচে লবণের কিছু বড় ধরনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হলো:
রক্তচাপ বৃদ্ধি ও হৃদ্রোগ
সোডিয়াম শরীরে পানি ধরে রাখে। ফলে রক্তের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেসার) বাড়ে। উচ্চ রক্তচাপ হলো হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের মতো প্রাণঘাতী অসুস্থতার প্রধান কারণ।
কিডনির ওপর চাপ
কিডনি অতিরিক্ত সোডিয়াম ফিল্টার করতে গিয়ে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায়। দীর্ঘদিন অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করলে কিডনি স্টোন, কিডনি ফেইলিওর এমনকি ডায়ালাইসিসের মতো অবস্থা তৈরি হতে পারে।
মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়া
সোডিয়ামের আধিক্য রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করে, যার ফলে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। এতে স্ট্রোক এবং স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি বাড়ে।
হাড় ক্ষয় (অস্টিওপোরোসিস)
অতিরিক্ত লবণ শরীর থেকে ক্যালসিয়াম নিঃসরণ বাড়ায়, ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যায়। বয়স্কদের মধ্যে এটি মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
পাকস্থলীর জটিলতা
অতিরিক্ত লবণ পাকস্থলীর অ্যাসিড বাড়িয়ে দেয়, সৃষ্টি করে গ্যাস্ট্রিক, আলসার এমনকি পেটের ক্যান্সার।
কাঁচা লবণ খাওয়ার ঝুঁকি
অনেকে ভাত বা ফলমূলের সঙ্গে কাঁচা লবণ খেতে পছন্দ করেন। কিন্তু ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারের পুষ্টিবিদ নুসরাত জাহান বলছেন, কাঁচা লবণ সরাসরি খাওয়ার ফলে সোডিয়াম শরীরে দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। এ ছাড়া কাঁচা লবণ খাওয়ার ফলে দেখা দিতে পারে—শরীরে পানি জমা (এডিমা), হাড় ক্ষয়, পাচনতন্ত্রে সমস্যা, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।
আরও পড়ুন: যত চিনি তত বিপদ: দিনে কতটুকু চিনি খাওয়া ঠিক?
প্রতিদিন কতটুকু লবণ খাবেন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সুপারিশ অনুযায়ী, বয়সভেদে প্রতিদিনের লবণ গ্রহণের নির্ধারিত একটি নিরাপদ মাত্রা রয়েছে। এর বেশি লবণ গ্রহণ শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ১১ বছর ও তার বেশি বয়সীরা সর্বোচ্চ ৬ গ্রাম (প্রায় ১ চা চামচ), ৭ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরা সর্বোচ্চ ৫ গ্রাম, ৪ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুরা সর্বোচ্চ ৩ গ্রাম, ১ থেকে ৩ বছর বয়সী শিশুরা জন্য সর্বোচ্চ ২ গ্রাম লবণ গ্রহণ করতে পারবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নির্ধারিত মাত্রার বেশি লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, কিডনি জটিলতা ও হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ে। তাই দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
লবণ খাওয়া কমানোর সহজ কিছু কৌশল
রান্নায় কম লবণ ব্যবহার করুন, খাবার টেবিলে অতিরিক্ত লবণ না রাখুন, চিপস, ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খান, স্বাদ বাড়াতে লেবু, ভিনেগার বা মশলার ব্যবহার বাড়ান, খাবার লেবেল দেখে সোডিয়াম মাত্রা যাচাই করুন।
লবণ স্বাদের জন্য জরুরি, কিন্তু অতিরিক্ত হলে সেটাই হয়ে উঠতে পারে নীরব ঘাতক। সামান্য অসচেতনতাই রূপ নিতে পারে দীর্ঘমেয়াদি রোগে। তাই এখনই সময় পরিমিত লবণ ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়ার। কারণ, ‘জীবন যদি হয় স্বাদে ভরা, স্বাস্থ্যের কথা ভুলে গেলে চলবে না!’