একের পর এক গবেষণা প্রকল্প, দেখা নেই প্রকাশনার

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি  © ফাইল ফটো

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক মো. মনোয়ার হোসেন। ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০— এ তিন অর্থ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত ছয়টি গবেষণাকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এ শিক্ষক। এর পাঁচটিতেই ছিলেন প্রধান গবেষক হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই ছয়টি গবেষণা প্রকল্পে বার্ষিক বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো ৬ লাখ টাকা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এই শিক্ষকের প্রোফাইলে কোনো প্রকাশনার তথ্য পাওয়া যায়নি। আর গুগল অনুসন্ধানে ছয়টির মধ্যে একটির কনফারেন্স পেপার এবং একটি মাত্র আর্টিকেল পাওয়া গেছে। 

প্রকাশনা বিষয়ে ওয়াকিফবহাল না খোদ গবেষকও। এ শিক্ষকের ভাষ্য, ‘গবেষণা প্রজেক্টগুলোর মধ্যে দু-একটার আর্টিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তবে কোনটি প্রকাশ হয়েছে আর কোনটি প্রকাশ হয়নি এরকম তথ্য আমার মনে নেই।’

শুধু প্রভাষক মো. মনোয়ার হোসেন নয়; ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত বশেমুরবিপ্রবির গবেষণা খাত থেকে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এমন মোট ১৫০ টি গবেষণার মধ্যে বেশির ভাগেরই কোনো প্রকাশনা পাওয়া যায়নি। গুগল স্কলার অনুসন্ধানে, এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৪ টি নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া বেশ কয়েকজন শিক্ষকের ক্ষেত্রে একটি গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন না করেই নতুন গবেষণার জন্য বরাদ্দ গ্রহণের তথ্য পাওয়া গেছে।

রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিগত পাচঁ অর্থবছরে গবেষণা খাতে মোট ১ কোটি ২৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো এবং এই গবেষণা প্রকল্পগুলোর সাথে ১৪৭ জন শিক্ষক সংশ্লিষ্ট ছিলেন । এদের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোঃ আশিকুজ্জামান ভুঁইয়া। তিনি ৫ বছরে মোট ৮ টি গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, যার মধ্যে ৬ টিতে ছিলেন প্রধান গবেষক। এসকল গবেষণায় মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এই শিক্ষকের প্রোফাইলে কোনো পাবলিকেশন্সের তথ্য পাওয়া যায় নি। এমনকি গুগল অনুসন্ধানেও কোনো পাবলিকেশন্সের তথ্য মেলেনি। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আশিকুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, “গবেষণা প্রকল্পগুলোর একটির কাজ শেষ হয়েছে, আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে এবং বাকিগুলোর কাজ এখনও চলছে।” এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের জন্য তিনি রেজিস্ট্রারের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।

আরও পড়ুন: গবেষণা প্রকল্প নিয়েছেন ১৪৭ শিক্ষক, প্রতিবেদন জমা পড়েছে মাত্র চারটি

এ ছাড়া এককভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন বশেমুরবিপ্রবির সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। তিনি ২০১৬-১৭,২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯ এ তিন অর্থ বছরে মোট ৬ টি গবেষণা প্রকল্পের বিপরীতে ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট গবেষণার শিরোনাম অনুযায়ী গুগল স্কলারে অনুসন্ধানে কোনো আর্টিকেল পাওয়া যায় নি। এছাড়া বশেমুরবিপ্রবির অর্থ দপ্তরের উপ-পরিচালক শেখ সুজাউদ্দিন জানিয়েছেন ইতোমধ্যে এই অর্থ ফেরত চেয়ে খোন্দকার নাসিরউদ্দিনকে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে তিনি এখন পর্যন্ত এসকল চিঠির কোনো উত্তর প্রদান করেননি।

খোন্দকার নাসিরউদ্দিন ছাড়াও ছয়টি গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. দেবব্রত পাল এবং কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক রাহাত হোসেন রবি। রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. দেবব্রত পাল ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে চারটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ টি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে একটি গবেষণা প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এই ছয়টি প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ছিলো ৭ লক্ষ টাকা যার মধ্যে “Elucidation the structures of some safer and effective phytochemicals against UTIS causing agents” শিরোনামের গবেষণায় ২০১৬-১৭ অর্থ বছর এবং ২০১৯-২০ শিরোনামে পৃথকভাবে মোট ২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ গ্রহণ করা হয়েছে। এসকল গবেষণার মধ্যে ড. দেবব্রত পাল তিনটিতে প্রধান গবেষক ছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এই শিক্ষকের প্রোফাইলে পাবলিকেশন্সের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে গুগল অনুসন্ধানে একটি পাবলিকেশন্সের তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে ড. দেবব্রত পালের সাথে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে সিএসই বিভাগের প্রভাষক রাহাত হোসেন রবি ২০১৭-১৮,১৮-১৯ এবং ১৯-২০ অর্থবছরে ছয়টি গবেষণায় মোট ৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে তিনটি গবেষণা প্রকল্পে তিনি ছিলেন প্রধান গবেষক। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এই শিক্ষকের প্রোফাইলেও কোনো পাবলিকেশন্সের তথ্য পাওয়া যায় নি। আর গুগল স্কলারে অনুসন্ধানে ২ টি আর্টিকেল এবং একটি কনফারেন্স লেটারের তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে রাহাত হোসেন রবি বলেন, তার অবশিষ্ট গবেষণা প্রজেক্টের কাজ এখনও চলমান।

এছাড়া ৫ টি করে গবেষণা প্রকল্পের সাথে জড়িত ছিলেন বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোঃ শরাফত আলী, একই বিভাগের আরেক সহকারী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল জোবায়ের এবং বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো: লুৎফুল কবির। এদের মধ্যে ড. মো: শরাফত আলী ২ টি গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এই শিক্ষকের প্রোফাইলে এগুলোর মধ্যে ২ টি পাবলিকেশন্সেস তথ্য পাওয়া গেছে। অপরদিকে মো: লুৎফুল কবির ২ টি গবেষণা প্রকল্পের এবং আবদুল্লাহ আল জোবায়ের একটি গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এই দুই শিক্ষকের প্রোফাইলে পাবলিকেশন্স সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া না গেলেও গুগল অনুসন্ধানে মো: লুৎফুল কবিরের একটি পাবলিকেশন্সের তথ্য পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এই তিন শিক্ষক ই জানান, মূলত গবেষণা প্রকল্পের সম্পূর্ণ দায়িত্বে থাকেন প্রধান গবেষক এবং তারা যতটুকু দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেগুলো সম্পন্ন করেছেন।

বিজিই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো: শরাফত আলী বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শেষে রিপোর্ট প্রদানের নিয়ম না থাকায় রিপোর্ট দেয়া হয় না। আর পাবলিকেশন্সের ক্ষেত্রে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট জার্নাল শিরোনাম পরিবর্তন করে দেয় তাই প্রস্তাবিত শিরোনাম অনুযায়ী অনুসন্ধান করলে আর্টিকেল পাওয়া যায় না। এছাড়া অনেকসময় আার্টিকেলগুলো এক্সেপ্টের ক্ষেত্রেও জার্নালসমূহ সময় নেয়।”

এ বিষয়ে বশেমুরবিপ্রবির ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন ড. মো: শাহজাহান বলেন, ‘গবেষণা খাত থেকে শিক্ষকদের বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে এর আগে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা ছিলো না। তবে বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। নীতিমালা সম্পন্ন হলে গবেষণা খাত থেকে যারা অর্থ নিয়েছে তাদের সকলের কাছেই গবেষণা প্রতিবেদন চাওয়া হতে পারে।’


সর্বশেষ সংবাদ