সেই এসআই’র বিরুদ্ধে শাবি ছাত্রের মৃত্যুর প্রতিবেদনে সত্য আড়ালের অভিযোগ

এসআই আকবর
এসআই আকবর  © ফাইল ফটো

২০১৯ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী তাইফুর রহমান প্রতীকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে প্রতীক আত্মহত্যা করেছে বলে জানানো হয়। এই মামলার তদন্ত কর্মিকর্তা ছিলেন সদ্য বরখাস্ত পুলিশের এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া।

২০১৯ সালের ১৪ই জানুয়ারি সিলেটের কাজলশাহ এলাকায় তাইফুর রহমান প্রতীকের ব্যাচেলর বাসার সিলিং ফ্যানের সাথে তার ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া যায়। তাইফুরের পরিবারকে আত্মহত্যার মৃত্যুর তথ্য জানিয়ে পরিবারের অনুপস্থিতে লাশ নামিয়ে মর্গে প্রেরণ করে অপমৃত্যুর মামলা দিয়েছিলেন তৎকালীন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদ্য বরখাস্ত হওয়া এস আই আকবর হোসাইন ভূঁইয়া। এমনকি লাশ ময়নাতদন্ত না করে পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য তাগাদা দেয়া হয়েছিল- এমন অভিযোগ তাইফুরের পরিবারের।

তাইফুরের পরিবার জানান, শিক্ষাগত জীবনে ফলাফল খারাপ করায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে তাইফুর রহমান প্রতীক। পরিবার সেই প্রেক্ষিতে আত্মহত্যার প্ররোচনা দাতা শিক্ষকদের দায়ী করতে গেলে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষক প্রতীককে মাদকাশক্ত বলে প্রচার করতে থাকে। অন্যদিকে আকবরের করা তদন্ত রিপোর্টে প্রতীককে মানসিক রোগী হিসেবে দেখানো হয়। তবে মানসিক সমস্যা কিংবা মাদকাসক্ত দুটির কোনটির প্রমাণ দেখাতে পারেনি পুলিশ।

পরিবারের দাবি, মৃত্যুর দুই দিন আগেও পারিবারিক উৎসবে হাস্যোজ্জ্বল প্রতীকের চোখে মুখে কোন বিষাদ দেখতে পায়নি প্রতীকের পরিবার। মাস খানেকের মধ্যে স্বপ্নের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাবে যে ছেলে সে কেন হতাশায় আত্মহত্যা করবে এমন প্রশ্ন ছিল প্রতীকের পরিবারের। তবে এ প্রশ্নের উত্তর ততদিন মিলেনি যতদিন প্রতীকের পরিবারের হাতে প্রতীকের সুরতহাল সময়ের ঝুলন্ত ছবি না পৌঁছায়। যে ছবির সাথে এস আই আকবরের করা সুরতহাল প্রতিবেদনের বিশাল গড়মিল খুঁজে পান প্রতীকের বাবা।

তদন্তকারী কর্মকতা সদ্য বরখাস্ত হওয়া এস আই আকবর কর্তৃক মৃতের লাশের তোলা ছবি এবং লাশ নামানোর পর তার প্রস্তুতকৃত সুরতহাল প্রতিবেদনের প্রাপ্ত গরমিলগুলো হচ্ছে- “মৃতের লাশ নামানোর পূর্বে তোলা ছবিতে মৃতের দুটি চোখ বন্ধ দেখা যায়। অথচ সুরতহাল রিপোর্টে একটি চোখ খোলা ও অপরটি বন্ধ লেখা হয়েছে।” সুরতহাল রিপোর্টে লেখা আছে, মৃতের ডান হাত অর্ধবাঁকা হয়ে পেটের উপর আছে। অথচ ছবিতে মৃতের দুই হাতই বাঁকা হয়ে গলার পাশে ফাঁসের কাপড়ে আটকানো ছিল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাম হাতের দুটি আঙ্গুল ফুলে গাঢ় নীল হয়ে আছে। মৃতের মুখ অর্ধ খোলা এবং জিহ্বায় কামড় দেওয়া। অথচ মৃতের ঝুলন্ত ছবিতে দেখা যায় মৃতের ঠোঁট দুটি একটু ফাঁকা কিন্তু মুখ বন্ধ রয়েছে। মৃতের জিহ্বা বের হয়নি এবং দাঁতে কামড় দেওয়া দৃশ্যমান নয়।প্রকৃতপক্ষে আঘাতের কারনে মৃতের ঠোঁট ফোলা ও রক্তাভ দেখা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মৃতের ডান পায়ের পাতা চেয়ারে লেগে থাকার কারনে কালো দাগ আছে। যা সম্পূর্ন বানোয়াট। প্রকৃতপক্ষে ছবিতে মৃতের ডান পা নয় বরং বাম পা প্রায় ৯০ ডিগ্রি বাঁকা অবস্থায় চেয়ারের মাঝখানে পরে আছে। আর যে কালো দাগের কথা বলা হয়েছে তা আঘাতের চিহ্ন বহন করছে। আঘাতের কারনে বাম পা ও এর গোড়ালি মোচড়ানো ও ভাঙ্গা দেখা যায়। বাম পা ও গোড়ালি ভাঙ্গা না থাকলে মৃত্যু যন্ত্রনার সময় পা সোজা হয়ে সে দাড়িয়ে যেত। যেভাবে ফাঁসের কাপড় গলার উপরে অর্থাৎ থুথুনিতে এবং দুটি হাত ফাঁসের কাপড়ের সাথে আটকানো ছিল, মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করার সময় উক্ত ফাঁস অবশ্যই খুলে যেত। যে পাতলা জাতীয় কাপড় দিয়ে থুথুনিতে লাগানো ফাঁস প্রায় ৮৫ কেজি ওজনের একটি লোক মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট ও নড়াচড়া কালে তার ভার বহনে যথেষ্ট নয়, তা অবশ্যই ছিঁড়ে যেত।

সবচেয়ে আকস্মিক ব্যাপার হলো, “ছবিতে ফাঁসের কাপড় এতই দূর্বল ছিল যে তাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য মৃতের শরীরের প্রায় ৪০ (চল্লিশ) ভাগ চেয়ারের উপর ভর দেওয়া ছিল তা ছবিতে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে তদন্ত কর্মকর্তা আকবর মৃতের ভবনের নীচ তলার গেইটে স্থাপিত সিসি টিভির ফুটেজ পরীক্ষার কথা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেননি। ২৭ই জানুয়ারি প্রতীকের বাবা নিজে সিসি টিভির ফুটেজ পরীক্ষাকালে দেখেন ঘটনার দিন ১৩ থেকে ১৪ই জানুয়ারি ২০১৯ এর ফুটেজ শূণ্য অথচ ঐ তারিখের আগে ও পরের ফুটেজ রয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা আকবর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ১৩ জানুয়ারি ১৯ইং রাত আনুমানিক ১০টা হতে রাত ২টার মধ্যে ঘটনা ঘটার কথা উল্লেখ করেছেন।”

ভবনের কেয়ার টেকার রাহুল জানায়, ঘটনার দিন অর্থাৎ ১৩ ই জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে তাইফুর প্রতীক তার বাসা হতে বের হয় কিন্তু তাইফুর প্রতীক ঠিক কয়টায় বাসায় ফিরে আসে সে তা জানতে পারেনি।

প্রতীকের পরিবার আরও বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা যেহেতু বলেছেন, “১৩ই জানুয়ারি আনুমানিক রাত ১০টা হতে ঘটনার সূত্রপাত। তাহলে এই সমীকরন মিলে যায় যে, প্রতীককে বাইরে থেকে মেরে এনে তার বাসার ফাঁসে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেননা সিসি টিভির এই প্রকার লুকোচুরি এর ইঙ্গিত দেয়।” এছাড়াও এসআই আকবর তাইফুরের ক্যামেরার মেমোরি কার্ড, সিম কার্ড তার পরিবারকে ফেরত দেননি।

প্রতীকের বাবা মো. তৌহিদুজ্জামান এই অমিলগুলো তুলে ধরে তার একমাত্র সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে চিফ মেট্রোপলিটন জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত, সিলেট এ গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর প্রতীক হত্যার পুনঃতদন্তের আবেদন করেন। কিন্তু প্রতীক হত্যার ২২ মাস ও আদালতে পুনঃতদন্তের আবেদনের ১ বছর ১ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও সে বিষয়ে আদালত এখনো পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি।

তাইফুর প্রতীকের বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের চেয়ারপার্সন শান্তা তাওহিদা বলেন, মৃতের তোলা ছবি ও পরে প্রস্তুতকৃত সুরতহাল রিপোর্টের অসংগতি ও গরমিল, সিসি টিভির ফুটেজ না থাকা ও তদন্ত কর্মকর্তা আকবর প্রতীকের মেমোরি কার্ড- সিম কার্ড না দেওয়ার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে এটাই পরিস্কার হয় যে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। যাকে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তদন্তের নামে আমাদের সাথে প্রহসন করা হয়েছে। কারণ তদন্ত রিপোর্টেও বলা হয়েছে প্রতীক হতাশা থেকে সুইসাইড করেছে। কিন্তু তার কোন প্রমাণ সে দেখাতে পারিনি। শান্তা প্রশ্ন তুলেন, এস আই আকবরের কী স্বার্থ রয়েছে প্রতীক হত্যাকে আত্মহত্যা নাটক সাজাবার। কোন ঈশ্বরদের ইশারায় সুইসাইড নাটক সাজানো হয়েছিল। প্রতীক হত্যার পুনঃতদন্ত হলে কাদের মুখোশ খুলে যাবে।

এ সময় এস আই আকবরকে রিমান্ডে নিয়ে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করে প্রতীকের মৃত্যুর পুনঃতদন্তের দাবী জানান তিনি।

সম্প্রতি সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশি নির্যাতনে মারা যান আখালিয়ার যুবক রায়হান। গত ১১ অক্টোবর দিবাগত রাত তিনটায় তাকে এ ফাঁড়িতে ধরে এনে ভোর ছয়টা পর্যন্ত নির্যাতন চালান এসআই আকবর। নির্যাতনের ফাঁকে রায়হানের হাতে একটি মোবাইল ফোন দেওয়া হয়। রায়হান সেই ফোনে পরিবারের কাছে কল করে জানান, ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে এসে যেন তাকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। এ তথ্য পেয়ে পরিবারের সদস্যরা টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে হাজির হলেও রায়হানের সঙ্গে তাদের দেখাই করতে দেওয়া হয়নি, নেওয়া হয়নি দাবিকৃত টাকাও। পরে জানানো হয়, গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে সিলেটসহ সারা দেশে তীব্র ক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ।


সর্বশেষ সংবাদ