বিশ্ববিদ্যালয় গোপালগঞ্জে, সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা থেকে
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৩, ০৬:৩৮ PM , আপডেট: ৩১ মে ২০২৩, ০৯:৪৮ PM
বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব প্রদানসহ, পঠন-পাঠন ও গবেষণার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে যাত্রা শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন।
বশেমুরবিপ্রবি আইন ২০০১ এর ২০নং ধারা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়টির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম রিজেন্ট বোর্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ, নিয়োগ, পরীক্ষা আয়োজন, ফলাফল ঘোষণা, এবং কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় সিদ্ধান্ত রিজেন্ট বোর্ডেই চূড়ান্ত হবে। আইনের ১৯ ধারা অনুযায়ী প্রতি ৬ মাস পর রিজেন্ট বোর্ডের একটি সভা আয়োজন বাধ্যতামূলক।
তবে অভিযোগ রয়েছে আইনে উল্লেখ থাকলেও বশেমুরবিপ্রবির রিজেন্ট বোর্ড সঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হয় না এবং তদন্ত প্রতিবেদনসহ অনেক বিষয়ই রিজেন্ট বোর্ডের এজেন্ডাভুক্ত করা হয় না। এমনকি গত ৯ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো রিজেন্ট বোর্ডের সভাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে রিজেন্ট বোর্ডের অনেক সদস্যই বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সশরীরে আসেননি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কেও অবগত নন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক খাইরুল আলম দায়িত্বে থাকাকালীন ২০১৪ সালে সর্বশেষ বশেমুরবিপ্রবি ক্যাম্পাসে রিজেন্ট বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বিগত কয়েকবছর যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়টির রিজেন্ট বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (এফআইইউ)। বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান শেখ কবির বশেমুরবিপ্রবির রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য হওয়াতেই মূলত এখানে রিজেন্ট বোর্ডের সভা আয়োজন করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন ২০১৩-১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিলনা বললেই চলে। এমনকি প্রশাসনিক ভবনের নির্মাণ কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। যাতায়াত ব্যবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। কিন্তু ওইসময়য়েও তৎকালীন ভিসি স্যার ঢাকায় রিজেন্ট বোর্ডের সভা করতে রাজি হননি।
এসময় তিনি আরও বলেন, কয়েকজন সদস্য ক্যাম্পাসে আসতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তৎকালীন ভিসি স্যার তাদের নামের তালিকা করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এবং চ্যান্সেলরের নিকট অভিযোগ পাঠাতে চেয়েছিলেন। এরপর পরের রিজেন্ট বোর্ডে সব সদস্যই এসেছিলেন এবং আর কখনোই কেউ অনিচ্ছা প্রকাশ করেননি। কিন্তু এখনতো আর সেই পরিস্থিতি নেই। গত কয়েকবছর ধরে রিজেন্ট বোর্ডের সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়ে যাওয়ায় এখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়াও কঠিন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী সংস্থার সদস্যরা যদি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ারই সময় না পান তাহলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কেই বা জানবেন কিভাবে আর সঠিক সিদ্ধান্তই বা নিবেন কিভাবে। আর এমনটা কিন্তু নয় যে আগে এখানে রিজেন্ট বোর্ডের সভা হয়নি। বরং ওইসময়েই এখানে রিজেন্ট বোর্ড আয়োজন অধিক চ্যালেঞ্জিং ছিল। তখনই যদি ক্যাম্পাসে রিজেন্ট বোর্ডের সভা আয়োজন সম্ভব হয় তাহলে এখন সম্ভব হচ্ছে না কেন! আমার মতে এটি প্রশাসনের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয় যে তারা ক্যাম্পাসে রিজেন্ট বোর্ডের সভা আয়োজন করতে পারছে না।
এসময় তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে আমলা ও রাজনীতিবিদরা সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং সবচেয়ে অবহেলিত বলা যায় শিক্ষকদের। হয়ত একারণেই ভিসি স্যার রিজেন্ট বোর্ডের সভা ক্যাম্পাসে আয়োজনের বিষয়ে জোর দিতে পারেন না। তবে ভিসি স্যার তার অবস্থানে স্ট্রং থাকলে এবং জোরালো ভূমিকা নিলে এসব জটিলতা কাটিয়ে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে রিজেন্ট বোর্ডের সভা আয়োজন করা সম্ভব। কেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে ইচ্ছুক না হলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানানো হোক এবং সরকার যেহেতু তাদের মনোনীত করেছে সরকার এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিক। যে বিশ্ববিদ্যালয়েই আসতে চায়না তাকে তো প্রয়োজন নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রিজেন্ট বোর্ডের সভা আয়োজনের বিষয়ে বোর্ডের সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. মো: শাহজাহান বলেন, একসময় তো বিশ্ববিদ্যালয়েই রিজেন্ট বোর্ডের সভা হতো। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে ঢাকায় হচ্ছে। বর্তমান ভিসি স্যার আসার পর কয়েকবারই বিশ্ববিদ্যালয়েই রিজেন্ট বোর্ডের সভা আয়োজনের বিষয়ে বলেছিলেন। বেশ কয়েকবার রিজেন্ট বোর্ডের সভায়ও বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। রিজেন্ট বোর্ডের অনেক সদস্যের ব্যস্ততা থাকে, গোপালগঞ্জ পর্যন্ত আসার সময় থাকেনা এসব কারণেই মূলত ঢাকায় হয়। তবে আশা করছি শীঘ্রই বিশ্ববিদ্যালয়েই রিজেন্ট বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এ বিষয়ে রিজেন্ট বোর্ডের অপর এক সদস্য শরীফ এনামুল কবির বলেন, রিজেন্ট বোর্ড কোথায় আয়োজিত হবে এটি ভিসি নির্ধারণ করেন। এটি তার বিষয়। তিনি যেখানে সভা আয়োজন করবেন সদস্যরা সেখানেই যাবে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য অভিযোগ করেন রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছাড়া করার নিয়ম নেই এমন অনেককিছুই উপাচার্য আগে করে পরে রিজেন্ট বোর্ডের অনুমতি নেন এবং যথাসময়ে সদস্যদের কাছে সভার কার্যনির্বাহী প্রেরণ করা হয় না।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর নামের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হচ্ছে তা হতাশাজনক। ৬ মাস পরপর রিজেন্ট বোর্ড আয়োজনের কথা থাকলেও গত ৯ মাসেও কোনো সভা হয়নি। একজন সদস্য হিসেবে আমি অবশ্যই চাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের ক্যাম্পাসেই রিজেন্ট বোর্ডের সভা আয়োজন করুক। আমরা স্বচক্ষেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি দেখি। কিন্তু আমাদের সভা করতে হয় ঢাকায়। এছাড়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়ের নিয়োগসহ অনেক সিদ্ধান্ত রিজেন্ট বোর্ডে পাস হওয়ার আগেই কার্যকর করা হয়েছে এবং অধিকাংশ সময় এক রিজেন্ট বোর্ডের কার্যবিবরনী পাই আরেক রিজেন্ট বোর্ড শেষে।
এ বিষয়ে বশেমুরবিপ্রবি উপাচার্য ড. একিউএম মাহবুব বলেন, রিজেন্ট বোর্ডের সভাতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই হওয়ার নিয়ম। আমি নিজেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য। তাদের রিজেন্ট বোর্ড ক্যাম্পাসেই অনুষ্ঠিত হয়। ব্যস্ততা থাকলেও সময় বের করে সেখানে যেতে হয়। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রিজেন্ট বোর্ডের সভা দীর্ঘদিন ঢাকায় হয়ে আসছে।
তিনি আরও বলেন, আমি দায়িত্বে আসার পর থেকেই চাই রিজেন্ট বোর্ডের সভা ক্যাম্পাসেই হোক। আমি কয়েকবার সভায়ও এ বিষয়ে বলেছি। কিন্তু আমাদের রিজেন্ট বোর্ডে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপসহ অনেক উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা রয়েছেন। তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকায় তাদের ব্যস্ততার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হয়। তবে আমি চেষ্টা করছি ক্যাম্পাসেই রিজেন্ট বোর্ডের সভা আয়োজন করতে। প্রয়োজনে সদস্যদের কাছ থেকে আমরা তাদের সুবিধাজনক সময় জেনে নিবো বা বেশ আগেই তাদের সময় জানিয়ে দিবো যাতে তারা ওই সময়ে ফ্রি থাকেন। আর এখনতো অনলাইনে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে। কেউ একান্ত উপস্থিত হতে না পারলে জুমে যুক্ত হতে পারেন।
যথাসময়ে সভা না হওয়া এবং কার্যবিবিরণী তৈরি না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, কিছুটা দেরি হয় এটা সত্যি। তবে আমাদের চেষ্টা থাকে সবকিছুয়ে সময়ানুযায়ী করার। কিন্তু আমাদেরতো পর্যাপ্ত লোকবল নেই তাই অনেকসময় সময়ক্ষেপন হয়।
উল্লেখ্য, বশেমুরবিপ্রবি আইনের ১৮নং ধারা অনুযায়ী রিজেন্ট বোর্ডে মোট ১২ ক্যাটাগরির ২৫ জন্য সদস্য থাকতে পারেন। পদাধিকারবলে উপাচার্য বোর্ডের চেয়ারম্যান। ১২ ক্যাটাগরির সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সংসদ নেতা কর্তৃক মনোনীত দুইজন সংসদ সদস্য, সরকার মনোনীত অন্তত যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার ২ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার মনোনীত তিনজন, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত তিনজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।
এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক তিনজন শিক্ষক প্রতিনিধি ও বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের বিভিন্ন মহাবিদ্যালয়ের দুজন অধ্যক্ষকে এবং রেজিস্ট্রারভুক্ত গ্রাজুয়েটদের নির্বাচনের মাধ্যমে ৫ জনকে রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির রিজেন্ট বোর্ডে প্রো-ভিসি এবং গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি ব্যতীত ১১ ক্যাটাগরির মোট ১৮ জন সদস্য রয়েছেন।