আদালতের পর্যবেক্ষণ

মিন্নির সর্বোচ্চ শাস্তি না হলে অন্য মেয়েরা বিপথগামী হবে

নিহত নয়ন বন্ড ও রিফাত শরীফের সাথে মিন্নি
নিহত নয়ন বন্ড ও রিফাত শরীফের সাথে মিন্নি  © ফাইল ফটো

বরগুনায় বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গতকাল এই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের সইমোহর হাতে পেয়েছে আসামী পক্ষ। রায়ে মিন্নির বিষয়ে আদালত বলেছেন, সে (মিন্নি) এই হত্যা পরিকল্পনার মূল উদ্যোক্তা। তাঁর কারণেই রিফাতের মা-বাবা পুত্রহারা হয়েছেন। আয়শার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তাঁকে অনুসরণ করে তাঁর বয়সী মেয়েদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই এ মামলায় তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।

এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান। রায়ে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে মিন্নিসহ ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বাকি চার আসামি খালাস পান।

গতকাল প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ের ৪২৫-২৬ ও ২৭ পৃষ্ঠায় আদালতের অবজারভেশনে বলা হয়েছে, ‘ওপরের আলোচনা হইতে দেখা যায়, আসামি রিফাত ফরাজী, রাব্বি আকন, সিফাত, টিকটক হৃদয়, মো. হাসান ও মিন্নি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ভিকটিম রিফাত শরীফ হত্যার অভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ঘটনার তারিখ, সময় ও স্থানে এই হামলার ঘটনা ঘটাইয়া তাকে খুন করে পেনাল কোডের ৩০২ ও তৎসহ পঠিত ৩৪ ধারায় মৃত্যুদণ্ড, অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তৎসহ অর্থদণ্ডের বিধান রহিয়াছে। উক্ত ৩৪ ধারা মূলত স্বতন্ত্রভাবে শাস্তির বিধান আরোপকারী কোনো ধারা নহে। উহা অপরাধের মূল শাস্তি আরোপকারী অন্যান্য ধারার পরিপূরক। উহাতে বলা হয়েছে, কতিপয় ব্যক্তি মিলিয়া তাহাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কোনো অপরাধজনক কাজ করিলে সেই অপরাধের জন্য তাহাদের প্রত্যেকে, সে একা উক্ত কাজ করিলে যেভাবে দায়ী হইত ঠিক সেইভাবেই দায়ী হইবে। তদানুসারে, এই মামলার ভিকটিম রিফাত শরীফকে খুন করিবার দায়ে উক্ত আসামীগণ সমানভাবে দায়ী।

অবজারভেশনে আরো বলা হয়েছে, ‘ওপরের আলোচনা হইতে দেখা যায়, আসামি মিন্নি এই মামলার ঘটনার পরিকল্পনার মূল উদ্যোক্তা (মাস্টারমাইন্ড) এবং তাহার কারণেই হতভাগ্য রিফাত শরীফ নির্মমভাবে খুন হইয়াছেন এবং তাহার পিতা-মাতা পুত্র হারা হইয়াছেন। তাহার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হইলে তাহার পদাঙ্ক অনুসরণে তাহার বয়সী মেয়েদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকিবে। তাই এই মামলায় তাহার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।

প্রকাশ্য দিবালোকে সনাতনী অস্ত্র রামদাও দ্বারা কোপাইয়া সংঘটিত এই মামলার নির্মম হত্যাকাণ্ড মধ্যযুগীয় বর্রতাকেও হার মানাইয়াছে। উক্ত নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটনকারী অন্যান্য আসামিরা প্রত্যেকে যুবক। তথ্য প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে যুবসমাজসহ দেশ বিদেশের সব বয়সের মানুষ উক্ত নির্মতা প্রত্যক্ষ করিয়াছে। এমতাবস্থায়, তাহাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তাহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া দেশের যুবসমাজ ভুল পথে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই তাহাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। এমতাবস্থায় উক্ত আসামিদের কৃত অপরাধের গুরুত্বসহ উল্লিখিত অবস্থাদি সার্বিকভাবে বিবেচনায় তাহাদের প্রত্যেককে পেনাল কোডের ৩০২ ও তৎসহ ৫০,০০০/- টাকার অর্থদণ্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল।’

রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা আপিল করতে চাইলে এই আদেশের ৭ (সাত) দিনের মধ্যে দায়ের করতে হবে। তাই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ অপর পাঁচ আসামির সব অভিভাবক রায়ের সহিমোহর নিয়ে ইতিমধ্যেই রাজধানী ঢাকায় রওনা হয়ে গেছেন।

তথ্যমতে, গত বছরের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজ এলাকায় দিনদুপুরে রিফাতকে কুপিয়ে মারাত্মক আহত করেন তাঁরই পরিচিত এক দল তরুণ। এরপর রিফাতকে হাসপাতালে নিয়ে যান আয়শা। হাসপাতালে নেওয়ার পর রিফাত মারা যান।

রিফাতকে যখন কোপানো হচ্ছিল, তখন তাঁর স্ত্রী আয়শা চেষ্টা করছিলেন স্বামীকে বাঁচাতে। এমন এক ভিডিও চিত্র তখন অনলাইনে ছড়িয়ে পড়লে দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছিল। ঘটনার ১৫ মাস পর আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, স্ত্রী আয়শাই ছিলেন রিফাত হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী।

আর রিফাতের ওপর আক্রমণে নেতৃত্বে ছিলেন সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড। যিনি ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় এলাকায় দুর্ধর্ষ একটি সন্ত্রাসী দল গড়ে তুলেছিলেন। ঘটনার এক সপ্তাহ পর পুলিশের সঙ্গে এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন নয়ন বন্ড। অভিযুক্ত বাকি আসামিদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ কিশোরের বিচার চলছে শিশু আদালতে।


সর্বশেষ সংবাদ