টেলিগ্রামে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রলোভন

এক পরিবারের ৯ সদস্যের অনলাইন প্রতারণা, ৩৪ কোটি টাকা পাচার

টেলিগ্রাম
টেলিগ্রাম  © সৌজন্যে পাওয়া

সংঘবদ্ধভাবে অনলাইন প্রতারণা ও জুয়া এবং হুন্ডি কার্যক্রমের মাধ্যমে ৩৪ কোটি টাকার পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে একটি পরিবারের ভাইবোন, মা ও ভগ্নিপতি নেতৃত্ব দিতেন। এ পরিবার অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অর্জিত ৩৪ কোটি টাকার মানি লন্ডারিং করে। সেই অভিযোগে এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সংশ্লিষ্ট ৯ জনসহ অজ্ঞাতনামা ৭-৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সিআইডি।

অভিযুক্তরা হলেন- আরিফুল ইসলাম রিফাত (২৩), মো. ইমরান হোসেন (৩০), মো. নুরে আলম (৩৮), মোছা. লিলি আক্তার (৫৫), মোছা. রিমি আক্তার (৩৪), রুমি আক্তার (৩৬), আব্দুল কাদির জিলানি (৪০), মুহা. নেয়ামতুল্লাহ (৩০) ও মো. রিয়াদ (২৫)। 

এ মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে প্রধান হোতাদের দায়িত্বে ছিলেন একই পরিবারের সদস্যরা। চক্রের মূল নায়ক আরিফুল ইসলাম রিফাত, তার মা লিলি আক্তার, দুই বোন রিমি আক্তার ও রুমি আক্তার, এবং বোনের স্বামী আব্দুল কাদির জিলানি সরাসরি প্রতারণার পুরো কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান এ তথ্য জানান।

জসীম উদ্দিন খান বলেন, এ প্রতারক চক্রটি প্রথমে টেলিগ্রামে বিভিন্ন মানুষের কাছে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের প্রস্তাব দিত। পরবর্তী সময়ে কেউ সম্মত হলে তাকে এমন একটি টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত করা হতো, যেখানে ওই টার্গেটকৃত ব্যক্তি ছাড়া বাকি সব আইডি ভুয়া। সেই গ্রুপে ভুয়া আইডিগুলোর পজিটিভ রিভিউ দেখে ভিকটিমরা ফ্রিল্যান্সিং কাজে সম্মত হলে তাদের প্রথমে সাধারণ কিছু কাজ দেওয়া হতো এবং প্রথমবার ৮-১০ হাজার টাকা প্রদান করা হতো। এতে ভুক্তভোগীর আস্থা অর্জন করা হতো, যেন মনে হয় সব ঠিকঠাক চলছে। একবার আস্থা তৈরি হলে তারা বড় প্রজেক্টের প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতো। প্রতারণার পাশাপাশি চক্রটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে তাদের অজ্ঞাতে ভুয়া ব্যাংক ও মোবাইল আর্থিক সেবার হিসাব খুলত। এসব হিসাব ব্যবহার করা হতো অনলাইন প্রতারণা, হুন্ডি ও জুয়ার অর্থ লেনদেনে।

তিনি বলেন, চক্রটি শুধু অনলাইন প্রতারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকত না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দরিদ্র ও নিরক্ষর মানুষদের টার্গেট করত। তাদের সরকারি ভাতার প্রলোভন দেখিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা হতো। এ পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ভুয়া ব্যাংক ও মোবাইল ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিস (বিকাশ, নগদ) অ্যাকাউন্ট খুলত। অনেক সময় মানুষ জানতও না যে তার নামে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এরপর এ অ্যাকাউন্টগুলো ব্যবহার করা হতো টেলিগ্রামে প্রতারণা, অনলাইন জুয়া ও হুন্ডির লেনদেনে। ভুক্তভোগীর জমা অর্থ ধীরে ধীরে চক্রের মূল সদস্যদের কাছে স্থানান্তরিত হতো।

তিনি আরও বলেন, চক্রটি দেশের অসাধু ব্যবসায়ী ও ঘুষ-দুর্নীতির অর্থও হুন্ডি ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে পাঠাতো। অর্থ স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত জটিল। চক্রটি একাধিক ভুয়া এবং পরিবারের সদস্যদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ছোট ছোট লেনদেনের মাধ্যমে প্রকৃত উৎস লুকিয়ে রাখত। এতে বাইরের কেউ সহজে বুঝতে পারত না কতটা অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরিবারের সদস্য ও সহযোগীরা একে অপরের অ্যাকাউন্টে পরপর অর্থ পাঠাতো, যাতে সবকিছু খুবই স্বাভাবিক দেখায়। 

সবশেষে, চক্রটি অর্জিত অর্থ ডিজিটাল হুন্ডি ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করত। তারা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ডলার বা ক্রিপ্টো ক্রয় করে তা বিদেশি ঠিকানায় স্থানান্তর করত। এককথায় চক্রটি আস্থা তৈরি করা, বড় প্রজেক্টের প্রলোভন দেখানো, ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা এবং ক্রিপ্টো বা হুন্ডি ব্যবহার; সবমিলিয়ে তারা মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।


সর্বশেষ সংবাদ