মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনা

চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পরিবারগুলো

মাইলস্টোন স্কুলের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত
মাইলস্টোন স্কুলের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত   © সংগৃহীত ছবি

গত ২১ জুলাই রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এক মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়। বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান স্কুলটির ওপর বিধ্বস্ত হয়। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ নিহত হয় ৩৬ জন, আহত হয় ১৫০ জন। গুরুতর আহতদের মধ্যে বর্তমানে ৫৭ জন হাসপাতালে ভর্তি ছিল, যাদের মধ্যে ৩১ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরলেও দগ্ধ শিশুদের পরিবার এখন আর্থিক ও মানসিক সংকটে পড়েছে। সরকারি ব্যয়ে চিকিৎসা হলেও  চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত আনুষঙ্গিক খরচ যেমন যাতায়াত, খাবার ও ফলোআপে ব্যাপক অর্থ ব্যয় হয়েছে। দুর্ঘটনার পর আহত শিশুদের মানসিক অবস্থাও এখনও স্থিতিশীল হয়নি।

মাইলস্টোনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে মারাত্মক আহত হয় পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী রুপি বড়ুয়া। তার হাত, পা, মুখ ও পিঠসহ শরীরের প্রায় ২০ শতাংশ পুড়ে যায়। তিন মাসেরও অধিক সময় ধরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা চলছে তার। এদিকে চোখের সামনে এত বড় দুর্ঘটনায় মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে। যার প্রভাবে পড়ালেখায় পূর্ণ মনোযোগী হতে পারছে না। স্বজনদের ভাষ্যমতে, দীর্ঘ সময় কাজ না করে পরিবারের সবাই মিলে রুপিকে সময় দেয়ায় এবং অতিরিক্ত খরচ হওয়ায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে পরিবারটি।

শুধু রুপি বড়ুয়া রয়া নয়, রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ ও আহত অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের একই চিত্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ দগ্ধ শিশু এখনো ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিলেও তাদের নিয়মিত চেকআপ করাতে হচ্ছে। অনেকের ক্ষত শুকালেও নিয়মিত ফিজিওথেরাপি নিতে হচ্ছে। এদিকে পরিবারের আদরের ছোট্ট সদস্যের চিকিৎসায় দু-হাতে অর্থ ব্যয় করে এখন আর্থিক সংকটে পড়েছেন স্বজনরা। বিনামূল্যে চিকিৎসা পেলেও আর্থিক কোনো সহযোগিতা পাননি তারা। এছাড়া পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা না পাওয়াসহ চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনেছেন স্বজনরা।

একই অভিযোগ মাইলস্টোনের পঞ্চম শ্রেণীর আরেক দগ্ধ শিক্ষার্থী কাফি আহমেদের স্বজনদেরও। ডান হাত, বুক ও মুখের ক্ষত পুরোপুরি না শুকালেও প্রায় এক মাস আগে তাকে রিলিজ দেন চিকিৎসকরা। এখনো দগ্ধ হাত নিয়ে ভোগান্তি পোহানোর অভিযোগ করেছেন কাফির মা। তিনি বলেন, ‘ডাক্তাররা তো রিলিজ দিতে পারলে বেঁচে যায়! রিলিজ দেয়ার সময় হাতে একটা অপারেশন করতে হবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসকরা এখন বলছেন যে সরকার আর চিকিৎসার ব্যয়ভার গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। পরে আমরা নিজেদের খরচে চিকিৎসা করাতে চেয়েছি। বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা মেডিকেল বোর্ড গঠন করে আমাদের জানাতে চেয়েছেন।’ চিকিৎসকরা আরো দুই বছর এভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে বলেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মধ্যবিত্তরা আর্থিক সংকট কাউকে বলতে পারে না। কেউ বুঝতেও চায় না। হঠাৎ এমন ঘটনায় প্রকট আর্থিক ও মানসিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কাফির মানসিক সমস্যাও দেখা দিয়েছে। এসব সরকারের বোঝা উচিত।’

চিকিৎসায় অবহেলার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন বিভাগের প্রধান মারুফ অর্পিও গণমাধ্যমে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে ভর্তি থাকা রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছি। তাদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য দেশের বাইরে থেকেও টিম এসেছে। এখন তারা কেন এ ধরনের অভিযোগ করছেন তা আমার জানা নেই। তবে সরকার থেকে ওষুধ ও সরঞ্জাম সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটেছে এটি সত্য। কারণ এত বড় দুর্ঘটনার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। তবে এখানে আমাদের চিকিৎসক ও নার্সরা সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি ভর্তি থাকা অবস্থায় চিকিৎসার পেছনে তাদের এক টাকাও খরচ হয়নি।’

তীব্র অর্থ সংকটের কথা জানিয়েছে চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী মেহরিনের স্বজনেরাও। শিশুটির শরীরের বিভিন্ন অংশ দগ্ধ হওয়ার পর টানা প্রায় তিন মাস বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ছিল। বর্তমানে মেহরিনের শারীরিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে নিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তার মামা ফাহাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওষুধপত্রসহ সব ধরনের চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করলেও যাতায়াত ও রোগীর খাবারসহ আনুষঙ্গিক অনেক খরচ আমাদের নিজেদের বহন করতে হতো। যদিও বিমান বাহিনী থেকে দুজনের খাবার দিত। সব মিলিয়ে হিসাব করে দেখেছি আমাদের ৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া রিলিজ পাওয়ার পর বর্তমানে ওষুধপত্র ও ব্যান্ডেজসহ সবকিছু নিজেদের কিনতে হচ্ছে। নিয়মিত ফলোআপের জন্য রোগীকে নিতে পরিবহন ব্যয়ও হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এই লম্বা সময় পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিসহ সবাই মেহরিনের পেছনে নিয়োজিত থাকায় আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তীব্র আর্থিক সংকটে পড়েছি আমরা। যা পরিবারের জন্য মানসিক সংকটেরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ এ অবস্থায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে সরকার, বিমান বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানান তিনি।

মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারকে ৫ কোটি টাকা ও আহত শিক্ষার্থীদের জন্য ১ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়েছে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন এ রিট দায়ের করেন।

এদিকে নিহত পরিবার ও আহত শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি নাজমুল হক বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেছি। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। কিন্তু ক্ষতিপূরণ মেলেনি। আমরা বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছি। ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা রিটের শুনানির দিকেও তাকিয়ে আছি আমরা।’

 

 

 

 


সর্বশেষ সংবাদ