ঢাকা কলেজের ১৮৪ বছরের ঐতিহ্য কি সংকটের মুখে?

‘নিজেকে জানো’ মূলমন্ত্রে ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বরে গোড়াপত্তন হয় দেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজের
‘নিজেকে জানো’ মূলমন্ত্রে ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বরে গোড়াপত্তন হয় দেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজের  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে ঢাকা কলেজের নাম এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রতিষ্ঠান শুধু ঢাকার নয়, গোটা দেশে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে এসেছে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে। উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত নানা স্তরের শিক্ষা কার্যক্রমে এটি দীর্ঘকাল ধরে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার আগে-পরের অসংখ্য রাষ্ট্রনায়ক, শিক্ষাবিদ, লেখক, কবি, বিজ্ঞানী ও প্রশাসক তৈরি করেছে এই প্রতিষ্ঠান। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর কারণে ঢাকা কলেজের এই ঐতিহ্য যেন বড় ধরনের সংকটে পড়েছে।

‘নিজেকে জানো’ মূলমন্ত্রে ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বরে গোড়াপত্তন হয় দেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজের। নানান চড়াই-উৎরাই আর প্রতিবন্ধকতার দেয়াল পেরিয়ে, শত কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সমৃদ্ধি আর সম্ভাবনার জাল বুনছেন হাজার হাজার বিদ্যার্থী। দেশ-বিদেশের অনেক মেধাবী সন্তান ধন্য হয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হয়ে। ঐতিহ্য-গৌরবের এই দীর্ঘ পথচলায় ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে অসংখ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রাজসাক্ষী এই কলেজ। শুধু এই দেশেই নয় বরং উপ-মহাদেশের বিদ্যারণ্য প্রবীণ এক বটবৃক্ষের নাম ঢাকা কলেজ। তবে শিক্ষার্থীদের শঙ্কা, প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোয় হারিয়ে যেতে পারে কলেজটি, সংকটে পড়তে পারে প্রায় ১৮৪ বছরের ঐতিহ্য। 

ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে নিয়ে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে ঢাকা কলেজ। প্রস্তাব অনুযায়ী সাত কলেজকে চারটি স্কুলে ভাগ করা হবে। এর মধ্যে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজে হবে স্কুল অব সায়েন্স। এতে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ক্লাস এবং এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেওয়া হবে, যা ‘টাইম-শেয়ারিং’ নামে প্রস্তাবিত হয়েছে। ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, এটি কার্যকর হলে কলেজের স্বকীয়তা হারাবে। 

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে ‘ঢাকা কলেজ’ নাম ধীরে ধীরে মুছে যাবে, আর তার জায়গায় জায়গা করে নেবে ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’। এতে আমাদের ১৮৪ বছরের ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাবে।” তাদের আরেকটি উদ্বেগ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি তুলতে পারে। আবার কলেজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সে বিষয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। 

শুধু শিক্ষার্থীরা নন, শিক্ষক সমাজও প্রস্তাবিত কাঠামো নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। গত সপ্তাহে সাত কলেজের কয়েক শ শিক্ষক ইউজিসির সামনে মানববন্ধন করেন এবং ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। তাঁদের বক্তব্য, প্রস্তাবিত কাঠামো কার্যকর হলে ভর্তি কমে যাবে, নারীশিক্ষার সুযোগ হুমকির মুখে পড়বে, আর শিক্ষকদের পদ-পদবিতেও জটিলতা তৈরি হবে। 

অন্যদিকে, সাত কলেজের কিছু শিক্ষার্থী অনেক দিন ধরেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। তাঁদের দাবি, দ্রুত অধ্যাদেশ জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। তারা বলছেন, “আজকের মধ্যে অধ্যাদেশ জারি না হলে বড় কর্মসূচি দেওয়া হবে।” 

ঢাকা কলেজ শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। এখান থেকেই বেরিয়ে এসেছেন ভাষা আন্দোলনের কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। কলেজটি একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল, আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেও ছিল। বর্তমানে এটি দেশের প্রাচীনতম কলেজ হিসেবে একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, নতুন কাঠামো প্রণয়ন করার সময় যদি ঐতিহ্য ও বিদ্যমান কাঠামোর স্বার্থ সুরক্ষিত না করা হয়, তবে শুধু ঢাকা কলেজ নয়, গোটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। 

উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে ইউজিসিতে গিয়ে অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু ইউজিসি জানিয়েছে, এটি তাদের এখতিয়ারের বাইরে। ফলে এখন শিক্ষার্থীরা সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট করেছেন, তারা সাত কলেজের জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে নন। তবে কাঠামো এমন হতে হবে, যাতে ঢাকা কলেজের ১৮৪ বছরের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ থাকে এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত না হয়। বিদ্যমান একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ হলে, এইচএসি কার্যক্রম বন্ধ হলে আন্দোলন গড়ে  তোলার হুমকি দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।


সর্বশেষ সংবাদ